১৯৪৯ সালের ১৬ জুলাই প্রথম নিলামে তোলা হয়েছিল তিন হাজার ব্যাগ চা। ১৯৮৫ সাল থেকে সপ্তাহে এক দিন করে নিলাম অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা চাষের সূচনা হয়েছিল। এ অঞ্চলে চা চাষের ইতিহাস দুই শতকের কাছাকাছি হলেও নিলামের বয়স সে তুলনায় কম। কারণ ব্রিটিশ আমলে লন্ডন ও কলকাতায় বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হতো এ অঞ্চলের উৎপাদিত চা। ভারত ভাগের পর ১৯৪৯ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামে চায়ের প্রথম নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই হিসাবে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে চায়ের নিলামের ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ অঞ্চলে চট্টগ্রামে চা চাষের সূচনা হলেও চা চাষের প্রসার ঘটে সিলেটে। এর পরও চট্টগ্রামেই প্রথম নিলামকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এর কারণ সম্পর্কে চা চাষের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রেলযোগাযোগ চালুর পর সিলেটসহ এ অঞ্চলে উৎপাদিত বেশির ভাগ চা রপ্তানি হতো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এতে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক চায়ের গুদামসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক অবকাঠামো থাকায় এখানেই নিলামকেন্দ্র চালু হয়। নানা জায়গা ঘুরে বর্তমানে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের প্রগ্রেসিভ টাওয়ারে সপ্তাহের প্রতি সোমবার এই নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম চা নিলামের আয়োজনের নেপথ্যে আছে বর্তমানের ‘ন্যাশনাল ব্রোকার্স লিমিটেড’। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিলামকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর। তখন বাংলাদেশ অঞ্চলে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) কোনো নিলামকেন্দ্র ছিল না। এ অঞ্চলের চা বিক্রির জন্য তৎকালীন ‘পাকিস্তান ব্রোকার্স লিমিটেড’ (বর্তমানে ন্যাশনাল ব্রোকার্স লিমিটেড) গঠন করেন পাঁচজন বিখ্যাত ব্যক্তি। ১৯৪৮ সালের ৬ জুন এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। চার ইউরোপিয়ানের সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান ব্রোকার্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খান বাহাদুর মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের বাবা।
চা বেচাকেনায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান গঠনের এক বছর পর ১৯৪৯ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামে প্রথম চায়ের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে তিন হাজার ব্যাগ চা নিলামে তোলা হয়। শুরুতে পাক্ষিক নিলাম হলেও ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বর্তমানে চা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিটিএবি) এই নিলাম পরিচালনা করে।
চট্টগ্রামে নিলামকেন্দ্র চালুর পরও এখানকার উৎপাদিত চা লন্ডনের নিলামে তোলা হতো। এই ধারা অব্যাহত থাকে বাংলাদেশ আমলেও। কারণ নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত চা চাষের বেশির ভাগ ছিল ব্রিটিশদের হাতে। পাকিস্তান টি অ্যাসোসিয়েশনের ১৯৫২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিলামকেন্দ্র চালুর দুই বছর পর ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪২৮ ব্যাগ চা বিক্রি হয়। একই বছরে লন্ডনের নিলামকেন্দ্রে বিক্রি হয় ২ লাখ ১১ হাজার ৭০৫ ব্যাগ চা। বাংলাদেশি চা সংসদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, লন্ডনে সর্বশেষ বাংলাদেশের চা নিলামে তোলা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সেবার ৯৮ হাজার কেজি চা নিলামে তোলা হয়।
টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা টিটিএবি সভাপতি শাহ মঈনুদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, চা নিলামের ৭৫ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতে নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের সিংহভাগই রপ্তানি হতো। তবে দেশে ভোগ বেড়ে যাওয়ায় নিলাম থেকে কেনা চায়ের বেশির ভাগ এখন দেশে বাজারজাত হচ্ছে। আবার অনলাইনেও পরীক্ষামূলক নিলামের আয়োজন করা হয়েছে। দেশে চায়ের নিলামকেন্দ্র এখন তিনটিতে উন্নীত হয়েছে।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিলামকেন্দ্র চালুর ৬৯ বছরের মাথায় ২০১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নিলামকেন্দ্র চালু হয়; আর ২০২৩ সালে পঞ্চগড়ে চালু হয় তৃতীয় নিলামকেন্দ্র। তবে এখনো বেশির ভাগ চা বিক্রি হয় চট্টগ্রামের নিলামে।
চা একমাত্র পণ্য যেটি উৎপাদনের পর নিলামে বিক্রি করতে হয়। তবে বাগানমালিকেরা চাইলে নিজেদের উৎপাদিত চায়ের ২৫ শতাংশ কর দিয়ে নিজেরা বাজারজাত করতে পারেন। এ জন্য অনুমতি নিতে হয় চা বোর্ডের। আবার আমদানি ও রপ্তানি করতে হয় চা বোর্ডের অনুমতি নিয়ে।
চা নিলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে চলতি নিলাম মৌসুমে। নিলামে চায়ের দরপতন ঠেকাতে ন্যূনতম মূল্যও বেঁধে দেওয়া হয়েছে এবার। এতে চলতি মৌসুমের নিলামে চায়ের ভালো দাম পাচ্ছেন বাগানমালিকেরা।
উপমহাদেশে চা চাষের সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে। চা চাষ, বিপণন, রপ্তানি ও বাগানের মালিকানা—সবই ছিল তাদের হাতে। তাদের হাত ধরে নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হলেও ধীরে ধীরে বাঙালি উদ্যোক্তারা যুক্ত হতে থাকেন চায়ের ব্যবসায়। বর্তমানে কয়েকটি ইউরোপিয়ান কোম্পানির মালিকানায় চা–বাগান থাকলেও এই শিল্পের সিংহভাগই রয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাতে।