চিনি আমদানিতে সম্প্রতি শুল্ক-কর কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাতে প্রতি কেজি চিনিতে কমবেশি ১১ টাকা শুল্ক-কর কমেছে। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে দেশের বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে এবং পণ্যটির দাম কমে আসবে। কিন্তু উল্টো পণ্যটির দাম কেজিতে পাঁচ টাকার মতো বেড়েছে।
খুচরা পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চার-পাঁচ দিন আগেও চিনির দাম ১২৫-১৩০ টাকা ছিল। সরকার প্রতি কেজি চিনিতে কমবেশি ১১ টাকা শুল্ক-কর কমিয়েছে। তাতে এখন চিনির দাম কমে প্রতি কেজি ১১৫-১২০ টাকা বা তারও কম হওয়ার কথা ছিল।
গতকাল রোববার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে এবং খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিক্রেতারা জানান, বাজারে খোলা চিনিই বেশি বিক্রি হয়। গত পাঁচ দিনের ব্যবধানে খোলা চিনির দাম কেজিতে পাঁচ টাকার মতো বেড়েছে। আর প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা।
পাইকারি বিক্রেতারা জানান, দাম বাড়ার মূল কারণ বাজারে চিনির সরবরাহ কম। বেশ কিছুদিন ধরেই এ অবস্থা চলছে। চিনির জন্য উৎপাদকদের (মিল পর্যায়ে) কাছে তারা ক্রয়াদেশ দিলে সেই চিনি আসতে সময় লাগছে আট-দশ দিন। আর মিল গেটে আগে কেনা চিনির জন্য বেশি দাম দিতে হয়েছে। ফলে তাঁদের এখন বাড়তি দামে তা বিক্রি করতে হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে চিনির পাইকারি বিক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, রাজধানীর মৌলভীবাজার থেকে তিনি চলতি সপ্তাহের শুরুতে ছয় হাজার টাকায় এক বস্তা চিনি কিনেছেন। সেই চিনি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ছেড়েছেন ৬ হাজার ২৫০ টাকায়।
খুচরা বিক্রেতারা অবশ্য বলছেন, তাঁদেরকে আরও বেশি দামে পাইকারি বাজার থেকে চিনি কিনতে হয়েছে। মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের খুচরা বিক্রেতা আবদুল আলীম বলেন, তিনি গত শনিবার ৬ হাজার ২৯০ টাকায় এক বস্তা চিনি কিনেছেন। আবার কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, তিনি গতকাল রোববার ৬ হাজার ৪০০ টাকায় চিনি কিনেছেন।
অবশ্য সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১২৮-১৩৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে তা ছিল ১২৫-১৩৫ টাকা; এক মাস আগেও প্রায় একই দাম ছিল।
চিনি উৎপাদকেরা অনেক দিন ধরে বলছিলেন যে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্যবৃদ্ধি ও দেশে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। চিনি আমদানিতে উচ্চ হারে নানা ধরনের শুল্ক-কর আরোপ ছিল, ফলে দেশের বাজারে চিনির দাম প্রতিবেশী দেশের চেয়ে অনেক বেশি।
এমন প্রেক্ষাপটে ৮ অক্টোবর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করে এনবিআর। এরপর পরিশোধিত চিনির সরবরাহ আরও বাড়াতে ১৭ অক্টোবর পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্কে ছাড় দেয় সংস্থাটি। তাতে প্রতি টন চিনি আমদানিতে বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সরকারের প্রত্যাশা ছিল, এতে চিনির মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, শুল্ক কমানোর পরে গত ১২ দিনে দেশে কোনো চিনি আমদানি হয়নি। ফলে হ্রাসকৃত শুল্কে নতুন চিনি না আসা পর্যন্ত দাম কমার সম্ভাবনা কম বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কম শুল্কের চিনি বাজারে কবে আসবে, তা জানাননি উৎপাদকেরা।
আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে (তিন মাসে) দেশে অপরিশোধিত চিনি এসেছে মোট ২ লাখ ৩৯ হাজার টন। আগের অর্থবছরের একই সময়ে দেশে ৩ লাখ ৯৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দেশে বিক্রি হওয়া চিনির একটি বড় অংশ আসে প্রতিবেশী ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন। ওই সরকারের পতনের পর কিছুদিন চোরাচালান বন্ধ ছিল। চোরাচালানের কারণে দেশের চিনিশিল্প অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে। এ কারণে চিনি আমদানি কমিয়ে দিয়েছিল দেশের পরিশোধন কারখানাগুলো। এখন তারা আমদানি না বাড়ানোয় বাজারে কিছুটা সরবরাহসংকট তৈরি হয়েছে। যদিও এখন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এ চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে বলে জানা যায়।
বর্তমানে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে তিন হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। পরিশোধিত চিনি আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের হার অপরিশোধিত চিনির ওপর থাকা শুল্কের দ্বিগুণ রাখা হয়েছিল। এর বাইরে উভয় ধরনের চিনি আমদানিতে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট, ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর এবং ক্ষেত্রবিশেষে ২-৫ শতাংশ অগ্রিম কর পরিশোধ করতে হয়।
গত পাঁচ বছরের গড় আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে ১৯ দশমিক ৬৯ লাখ টন করে চিনি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৪৩ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি এবং ১ লাখ ২৬ টন পরিশোধিত চিনি; অর্থাৎ প্রতিবছর যত চিনি আমদানি হয়, তার সিংহভাগই অপরিশোধিত চিনি, যা দেশে আনার পর পরিশোধন করে বাজারজাত করা হয়।
মূলত বেসরকারি খাতের কয়েকটি কোম্পানি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে এবং পরিশোধনের পর তা বাজারে সরবরাহ করে। ফলে চিনির বাজার মূলত গুটিকয় কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল।