সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাই শহরের মীনা বাজারে গেলে আপনার হয়তো মনেই হবে না যে আপনি মুম্বাই থেকে ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ, এদিক–ওদিক যেদিকেই তাকান, আপনার চোখে পড়বে বিরিয়ানিওয়ালা, মিনি পাঞ্জাব রেস্তোরাঁ ও তানিশক জুয়েলারির মতো ভারতের বহুল পরিচিত বিভিন্ন ব্র্যান্ড।
শুধু বিপণিবিতান বা বিক্রয়কেন্দ্রই নয়, সেখানে রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক অব বরোদার মতো বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। দুবাইয়ের ভাষা আরবি হলেও সেখানকার মীনা বাজারে যে কেউ চাইলে হিন্দি কিংবা মালয়ালম ভাষায় অনায়াসে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারবেন।
কয়েক দশকের ব্যবধানে ভারত ও ইউএইর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমাগতভাবে দৃঢ় হয়েছে। এর ফল হিসেবেই ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা–বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দুবাইয়ের মীনা বাজার। শুধু এই এলাকাতেই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতজুড়েই ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। অবস্থা এমন যে আপনার দুবাইয়ে থাকার মানে যেন আপনি কোনো না কোনোভাবে ভারতীয় ব্যবসা–বাণিজ্যের অংশ হয়ে আছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়িক চেম্বারগুলোর সূত্রে জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ৮৩ হাজার ভারতীয় কোম্পানির কার্যক্রম রয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালেই প্রায় ১১ হাজার ভারতীয় নাগরিক সেখানে কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করেছেন। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরব আমিরাতের নিজস্ব নাগরিকের সংখ্যা মাত্র ১২ লাখ। সেখানে দেশটিতে প্রায় ৩৫ লাখ ভারতীয় বাস করেন। এই ভারতীয়রা ২০২১ সালে প্রায় ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমান প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছেন।
দেশওয়ারি হিসাবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় যায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোতে। মেক্সিকোর নাগরিকেরা ২০২১ সালে প্রায় ৫ হাজার ২৫৯ কোটি মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন দেশে। এরপরেই সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে নিজেদের দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় পাঠান ভারতীয় নাগরিকেরা। এ জন্য মুম্বাইয়ের অনেকেই রসিকতা করে ইউএইর রাজধানী আবুধাবি ও বাণিজ্যিক শহর দুবাইকে ভারতের দুটি পরিচ্ছন্ন শহর বলে ডাকেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) জন্য খাদ্য, রত্ন, গয়না, ওষুধ, চামড়া, মানবসম্পদ ও বিনিয়োগের অন্যতম উৎস ভারত। আর ভারতের জন্য ইউএই হলো বৈশ্বিক বাণিজ্য ও মূলধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ক–করের উচ্চ হার ও সরবরাহব্যবস্থায় বিলম্ব—এসব সমস্যায় পড়েন। কিন্তু দুবাইয়ে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে এসব সমস্যায় পড়তে হয় না তাঁদের।
গত শতকের সত্তরের দশকেও আবুধাবি ছিল নিদারুণ দরিদ্র একটি দেশ। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় মুদ্রা রুপির একটি সংস্করণ আবুধাবিতে স্থানীয় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) স্বাধীন হয়। এর আগে দেশটির বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হতো।
আগে হীরা, মুক্তা ও রত্নের জন্য ভারতের মুম্বাই ছিল প্রধান বৈশ্বিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের বাণিজ্য শুরু হওয়ার পর এই চিত্র বদলাতে থাকে। তখন শুধু জ্বালানি তেল নয়, অন্যান্য ব্যবসারও বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বিশেষ করে দুবাই শহর।
দেশটির অর্থনৈতিক বিকাশের শুরু থেকেই সেখানে খুঁটি গাড়তে থাকেন ভারতীয়রা। দুই দেশের নাগরিকদের পারস্পরিক আসা–যাওয়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই অবস্থায় দুবাইয়ের সবচেয়ে পরিচিত বিমান সংস্থা এমিরেটস এয়ারলাইনসকে প্রতি সপ্তাহে ৬৬ হাজার যাত্রী পরিবহনের সীমা বেঁধে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এমিরেটস ভারতের কাছে আরও ৫০ হাজার আসন বরাদ্দ চাইছে।
মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ীরা প্রায়ই আরব আমিরাতে গিয়ে দিনে দিনেই ফিরে আসেন। আবার অনেকে ১০ বছরের গোল্ডেন ভিসা নিয়ে সেখানে থাকছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটির (ইউএই) বড় সংস্থাগুলোর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাদের প্রায় ৬০ শতাংশই ভারতীয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পদশালী ভারতীয়দের জন্য নতুন আবাসিক ঠিকানা হলো দুবাই। ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি গত বছরের আগস্টে আট কোটি মার্কিন ডলারে দুবাইয়ে একটি বাড়ি কিনেছেন। গত বছর ভারতীয়রা দুবাইয়ে আবাসনের জন্য প্রায় ৪৩০ কোটি ডলার খরচ করেছেন, যা ২০২১ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।
ইউএইতে ব্যক্তিগত করে ছাড় রয়েছে। অথচ ভারতে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি আয়কর দিতে হয়। এ ছাড়া উচ্চ হারের করপোরেট করহার নিয়েও জটিলতায় পড়তে হয়। এ জন্য কর সুবিধা পেতে অনেক ভারতীয় দুবাইয়ে বিনিয়োগ করেন।
দীর্ঘদিন ধরে কঠোর ধর্মীয় শাসনের অধীনে থাকলেও ইউএই এখন ধর্মীয় বহুত্ববাদে উদার হয়েছে। যেমন আবুধাবিতে সম্প্রতি একটি বড় হিন্দু মন্দির গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া রয়েছে সম্মিলিত মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি কেন্দ্রও।
ইউএইর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও কাজে লেগেছে। ২০২০ সালে ভারত ও এশিয়ার শীর্ষ অতিধনী মুকেশ আম্বানি ভারতে বিনিয়োগের জন্য ইউএইর বিভিন্ন সার্বভৌম তহবিল থেকে কয়েক শ কোটি ডলার সংগ্রহ করেন। ‘বেইন’ নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইউএইর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভারতে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ভারতের কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক, নির্মাণপ্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপ কোম্পানিতে ইউএইর সরাসরি মালিকানা রয়েছে। এসব বিষয় ইঙ্গিত দেয় যে আমিরাতও ক্রমান্বয়ে ভারতের জন্য একটি বিকল্প আর্থিক রাজধানীতে পরিণত হচ্ছে।
অনুবাদ করেছেন: শফিকুল ইসলাম