এক মাস আগেই চড়েছে রোজার পণ্যের দাম

রমজান মাসে ছোলা, খেজুর, চিনি ও ভোজ্যতেলের সঙ্গে মাংস ও ডিমের মতো পণ্যের চাহিদাও তুলনামূলক বেশি থাকে।

নিত্যপণ্য
নিত্যপণ্য

সাধারণত রমজান এলেই বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। কিন্তু রোজা শুরু হতে এখনো এক মাসের বেশি সময় বাকি। এরই মধ্যে রোজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত চার পণ্য খেজুর, ছোলার ডাল, চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বেড়েছে মাছ, মাংস ও ডিমের দাম। রোজা আসতে আসতে এসব পণ্যের দাম আরও কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক মাসে ছোলার দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় উঠেছে। মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। আর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত বছরের এই সময়ে বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে ছোলার দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি। ছোলার ডালের দামও কেজিতে ১০ টাকার বেশি বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি ছোলার ডাল ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দেশে চিনির বাজার আগে থেকেই অস্থির ছিল। ইতিমধ্যে বাজারে আবারও চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। প্যাকেটজাত চিনি একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না। খোলা চিনির সরবরাহেও ঘাটতি চলছে। সরকার গত সেপ্টেম্বর থেকে চার দফায় চিনির দাম বেঁধে দিয়েও বাজার স্বাভাবিক করতে পারেনি। ফলে রমজানকে কেন্দ্র করে আরেক দফা বড় সংকটের শঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। এক বছরে চিনির দাম বাড়ল ৪৮ শতাংশের বেশি।

অনেক পণ্যের ঋণপত্র খুলতে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। তাতে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন যে রমজানে খেজুর ও ছোলার মতো পণ্যের দাম আরও কিছুটা বাড়তি থাকতে পারে
—মো. বশির উদ্দিন, সভাপতি, মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি।    

বাজারে রোজার পণ্যের মধ্যে খেজুরের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরা বাজারে জাতভেদে খেজুরের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। দাবাস ও তিউনিসিয়ান জাতের মতো সাধারণ মানের খেজুরের কেজি এখন ১৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। টিসিবির হিসাবে গত এক বছরে সাধারণ মানের এসব খেজুরের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।

আর এক মাসে আগে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া আজোয়া খেজুর এখন ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইরানি মরিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। এই খেজুরের দাম এক মাস আগেও ছিল ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি। সৌদি মরিয়ম খেজুরের দামও বেড়েছে। এটির দাম কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে এখন ৯০০ টাকার আশপাশে ঘুরছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খেজুরের মতো ফল বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। এদিকে ঋণপত্র (এলসি) খোলায়ও জটিলতা আছে। আমদানিতে যেটুকু খরচ বেড়েছে, খেজুরের দাম সেটুকু সমন্বয় হচ্ছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, গত বছরের রোজায় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৫৮ থেকে ১৭০ টাকা। বাজারে এখন বোতলজাত সয়াবিনের লিটার ১৯০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম গত এক মাসে বাড়েনি। তবে খোলা সয়াবিন, পাম ও পাম সুপার তেলের দাম বেড়েছে।

এদিকে রমজানে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে মানুষ রোজা রাখতে চান বলে মাছ, মাংস ও ডিমের চাহিদাও বেশি থাকে। এসব পণ্যের দামও বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম গত কয়েক সপ্তাহে কেজিতে ১০০ টাকার ওপরে বেড়ে এখন ২৫০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। আর ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা। রোজায় বেশি পরিমাণে লাগে, এমন পণ্যের মধ্যে শুধু পেঁয়াজের দাম কম। তবে তা হয়েছে এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম বলে। এবার পেঁয়াজের দেশীয় উৎপাদনও ভালো।  

রোজার পণ্যের চাহিদা যেমন থাকে

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখ টনের ওপরে ছোলার প্রয়োজন হয়। প্রতিবছর আমদানি হয় দুই লাখ টনের মতো। এর মধ্যে শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে প্রায় এক লাখ টন। স্থানীয়ভাবে ছোলার উৎপাদন একেবারে নগণ্য। তাই পণ্যটির চাহিদা পূরণে আমদানির ওপরেই নির্ভর করতে হয়।

দেশে প্রতিবছর আমদানি করা খেজুরের চাহিদা আছে ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টন। এর অর্ধেক, অর্থাৎ প্রায় ৫০ লাখ টন খেজুরের চাহিদা থাকে রমজান মাসে। কারণ, অধিকাংশ মানুষই ইফতারে খেজুর খেয়ে থাকেন। সে জন্য রোজায় পণ্যটির চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

দেশে বছরে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে ২০ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেল আমদানি হয়। এর মধ্যে রোজায় ভোজ্যতেলের চাহিদা সাড়ে ৩ লাখ টন। তেল সাধারণত অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করে পরিশোধন করা হয়। আবার বীজ আমদানি করেও তেল উৎপাদন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে আখ থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ হাজার টন। অথচ দেশে পরিশোধিত চিনির চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন, যার মধ্যে ৩ লাখ টনই লাগে রমজানে। সাধারণত মাসে যেখানে দেড় লাখ টন চিনি লাগে, রমজানে তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ও আমদানির উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, দেশে ডলার–সংকটের কারণে সাম্প্রতিক কালে এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র কম খোলা হয়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে তীব্র সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে বাজারে পণ্যের অতিরিক্ত সরবরাহ না থাকায় দাম বেড়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে কারসাজির আশঙ্কাও থাকে।

বাজার স্বাভাবিক রাখতে নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন উল্লেখ করে পুরোনো ঢাকার আমদানিকারক ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তবে সংকট এখনো বিরাজমান। অনেক পণ্যের ঋণপত্র খুলতে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। তাতে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন যে রমজানে খেজুর ও ছোলার মতো পণ্যের দাম আরও কিছুটা বাড়তি থাকতে পারে।