একনেক সভা হচ্ছে না কেন

  • মাত্র ১২টি প্রকল্প একনেকে উত্থাপনের জন্য প্রস্তুত

  • আগের মতো প্রকল্প আসে না, ফেরত যাচ্ছে বহু প্রকল্প

  • হোস্টেল নির্মাণ, সিটি এলাকায় নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি, পৌরসভায় ভবন নির্মাণের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পাস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়

উন্নয়ন প্রকল্প পাসের একমাত্র জায়গা হলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। কিন্তু এখন প্রকল্প পাসে মনোযোগ কম। গত ছয় মাসে মাত্র সাতটি একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর মূল কারণ, সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ী নীতি। এর পাশাপাশি অর্থের জোগানেও ঘাটতি আছে।

গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১২টি একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। দেড় মাস ধরে কোনো একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। আলোর মুখ দেখেনি বহু উন্নয়ন প্রকল্প।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সব মিলিয়ে সাতটি একনেক সভায় মোট ৪৮টি প্রকল্প উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। জুলাই, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে একটি করে একনেক সভা হয়। আগস্ট ও নভেম্বর মাসে দুটি করে একনেক সভা হয়েছে। মূলত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ওই প্রকল্পগুলো অনুমোদন হয়। কারণ, ডিসেম্বর মাসে কোনো একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। সব মিলিয়ে গত ছয় মাসে ৪৮ হাজার ২১৪ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়েছে।

বড় অবকাঠামো প্রকল্প বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অগ্রাধিকার প্রকল্প পাস করা হচ্ছে না। ঠিকাদারদের চাহিদামতো একনেকে ঠিকাদারদের মুরব্বিরা প্রকল্প পাস করেন। উন্নয়ন প্রকল্প পাস করার যেন এটাই নীতি হয়ে গেছে। এই সংকটের সময়ে এর ব্যতিক্রম হয়নি। কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ৫০ শতাংশ প্রকল্প বাদ দেওয়া যাবে।’ তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালীরা নিজের এলাকার জন্য প্রকল্প পাস করিয়ে নেন। একনেকে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প তুলনামূলক কম পাস হয়।

গত ছয় মাসের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাস হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে ৪৪টি প্রকল্পের অনুমোদন ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এই ছাড়পত্রের মানে হলো, এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দে আর কোনো বাধা নেই। ওই ৪৪টি প্রকল্পের মধ্যে ২৯টি প্রকল্পই নতুন। অর্ধেকের বেশি প্রকল্প অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত। এ ছাড়া এসব প্রকল্পের মধ্যে হোস্টেল নির্মাণ, রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খাল সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র আধুনিক করা; বিভাগীয় ও পৌরসভায় ভবন নির্মাণের মতো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আছে।

আগের মতো প্রকল্প প্রস্তাব আসে না

দেড় মাস ধরে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প চূড়ান্ত করার কাজে বেশ শ্লথগতি। কারণ, আগের মতো আর প্রকল্প পাঠাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের শুরুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে প্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাড়া প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে অনেক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে প্রকল্প প্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন করে একনেকে উত্থাপনের জন্য সুপারিশ করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত একনেকে উত্থাপনের জন্য মাত্র ১২টি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। এই তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কম। জমি অধিগ্রহণ, ফিল্ম সিটি নির্মাণ, চট্টগ্রামের পটিয়ার শ্রীমাই নদীতে বাঁধ নির্মাণের মতো প্রকল্প আছে। সরকার যখন ব্যয় সাশ্রয়ের কথা বলছে, তখন এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, আগে একনেকে উত্থাপনের জন্য একসঙ্গে ২৫-৩০টি প্রকল্প প্রস্তুত থাকত।

বহু প্রস্তাবিত প্রকল্প মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হচ্ছে। বড় বাজেটের প্রকল্প কাটছাঁট করে ছোট করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি জিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু বিশাল ব্যয়ের প্রকল্পটি ছোট করতে ফেরত পাঠানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে গাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণ থাকলে তা ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রায় দুই মাস পর ১৭ জানুয়ারি পরবর্তী একনেক সভা হবে। ওই সভায় দ্রুতগতিতে ইভিএম কেনা প্রকল্প এবং হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তুত করা হচ্ছে।

টাকার জোগান কম

একনেক সভা মানেই নতুন নতুন প্রকল্প পাস। ওই সব প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয় সন্তোষজনক নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই–নভেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৯ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। ওই সময় এনবিআর ১ লাখ ১৫ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় করেছে। ওই সময়ে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকল্পের গাড়ি কেনা, বিদেশ ভ্রমণসহ অপ্রয়োজনীয় খরচে অর্থ ছাড় বন্ধ করেছে। তাই মন্ত্রণালয়গুলো প্রকল্প নিতেও নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

বর্তমানে এডিপিতে ১ হাজার ৩৬৩টি প্রকল্প আছে। অর্থনীতির এই চাপের সময়ে সরকার সম্প্রতি এই প্রকল্পগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণিতে ভাগ করেছে। ‘এ’ শ্রেণির প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মানে চলতি এডিপিতে যা বরাদ্দ আছে, তা পুরোটাই খরচ করবে। বি শ্রেণিতে থাকা প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ (দেশজ উৎসের অর্থ) ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। ‘সি’ শ্রেণির প্রকল্প নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। ৬৪৬টি প্রকল্প ‘এ’ শ্রেণিতে, ৬২৮টি প্রকল্প ‘বি’ শ্রেণিতে এবং ৮১টি প্রকল্প ‘সি’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। বাকি নয়টি প্রকল্প কোনো শ্রেণিতে রাখা হয়নি।