আর্থিক লেনদেনে মুঠোফোনের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। উন্নত বিশ্বে ৪৮ শতাংশ মানুষ পণ্য ও সেবা কিনতে এখন মানিব্যাগের বিকল্প হিসেবে মুঠোফোন ব্যবহার করছেন। যার নাম ‘ডিজিটাল ওয়ালেট’। এতে করে নগদ অর্থ লেনদেনের ঝুঁকি এড়ানোর পাশাপাশি ক্রেডিট, ডেবিট ও ডিসকাউন্ট কার্ড বহনের বাড়তি ঝামেলা থেকে গ্রাহকেরা রেহাই পাচ্ছেন।
সুইডেনের বহুজাতিক মুঠোফোন নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এরিকসনের গবেষণা বিভাগ ‘এরিকসন কনজ্যুমার ল্যাবের’ করা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে লন্ডন, নিউইয়র্ক, সাংহাই, সিডনি, টোকিওর মতো উন্নত বিশ্বের ১০টি শহরের অ্যাপলের আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড প্রযুক্তির পাঁচ হাজারের বেশি মুঠোফোন ব্যবহারকারী অংশ নেন। জরিপ বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে ডিজিটাল ওয়ালেট বা স্মার্টফোনেই বিশ্বের মোট আর্থিক লেনদেনের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হবে।
শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ‘ডিজিটাল ওয়ালেটের’ মাধ্যমে পণ্য ও সেবা কিনতে মুঠোফোন ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে টাকা আদান-প্রদান ছাড়াও মুঠোফোনে টাকা রিচার্জ, ট্যাক্সির ভাড়া পরিশোধ, দোকানে কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ, বিমান ও বাসের টিকিট, হাসপাতালের বিল পরিশোধে এ ব্যবস্থা ব্যবহার করছেন অনেকেই।
দেশের মধ্যে বর্তমানে মুঠোফোনে ডিজিটাল ওয়ালেট সেবা দিচ্ছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিকাশ, ডাচ্-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং, ইউক্যাশ, এমক্যাশ প্রভৃতি। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিং নামে টাকা আদান-প্রদানের মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়েছে। তবে এই সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে অন্যান্য সেবা দিতেও ঝুঁকছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
টাকা আদান-প্রদানের পাশাপাশি ডিজিটাল ওয়ালেটের বিভিন্ন সেবা চালুর ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করা ব্র্যাক ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিকাশ। বিকাশ ওয়ালেটের মাধ্যমে এখন মুঠোফোনের ব্যালান্স রিচার্জ, কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ, জমানো টাকার ওপর সুদ, প্রবাসী-আয় পাঠানো, কর্মীদের বেতন দেওয়ার মতো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
একজন বিকাশ ওয়ালেট ব্যবহারকারী ঘরে বসেই গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল নম্বরে মুঠোফোনে রিচার্জ করতে পারছেন। এর ফলে নারীরা অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনা এড়াতে পারছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা তাবাসসুম বলেন, ‘আগে আমাকে মুঠোফোনে ব্যালান্স রিচার্জের জন্য বাসা থেকে দূরের দোকানে যেতে হতো। এ জন্য প্রায়ই নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। কিন্তু বিকাশ ওয়ালেট দিয়ে এখন আমি যেকোনো সময় আমার মুঠোফোনে টাকা রিচার্জ করতে পারছি।’
মুঠোফোনে কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ একইভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে। বড় সুপারশপ থেকে শুরু করে হোটেল, রেস্তোরাঁয় বিকাশের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশব্যাপী প্রায় চার হাজার প্রতিষ্ঠানে বিকাশ ওয়ালেটের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সুযোগ আছে।
বিকাশের মুখপাত্র জাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিকাশ দিয়ে কেনাকাটায় বাড়তি কোনো টাকা প্রদান করতে হয় না। আর একটা সময় আসবে, যখন বেশির ভাগ আর্থিক লেনদেনই সম্পন্ন হবে ডিজিটাল ওয়ালেট বা মুঠোফোন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
ডিজিটাল ওয়ালেট-ব্যবস্থাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই এখন বিকাশের লক্ষ্য বলে জানান জাহেদুল ইসলাম। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যে ব্যক্তি রিকশা চালিয়ে বিকাশের মাধ্যমে তাঁর বাড়িতে টাকা পাঠান, একই ব্যক্তিই ঢাকা থেকেই যেন তাঁর গ্রামের মুদি দোকানের টাকা পরিশোধ করতে পারেন, এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
সারা দেশে এক লাখের বেশি এজেন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা পাঠানোর সুযোগ দিচ্ছে ডাচ্-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং। পাশাপাশি গ্রাহকেরা এখন ডাচ্-বাংলার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৬৫টি প্রতিষ্ঠানে সেবা বিল পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন ডিজিটাল হিসাবের মাধ্যমে।
ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেনের নিরাপত্তা সম্পর্কে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিটি লেনদেন একটি নির্দিষ্ট পিন নম্বর দিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই মুঠোফোন বা সিম হারিয়ে গেলেও ডিজিটাল ওয়ালেটে টাকা খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে গোপন পিন নম্বর মুঠোফোনে সংরক্ষণ না করার পরামর্শ তাঁদের।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং সেবা পায় না এমন জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ২৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে মুঠোফোনে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি ব্যাংক তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যাংক হিসাব সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫১ লাখ। মুঠোফোন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে।