৫ হাজার কোটি টাকায় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের পরিবর্তে মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
ওয়ার্কার্স পার্টির আয়োজনে আজ শনিবার জুম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের আধুনিকায়ন না ধ্বংস সাধন? পাট খাত সুরক্ষায় ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে এমন অভিমত উঠে এসেছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সঞ্চালনায় এতে মূলপত্র উপস্থাপন করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।
বক্তারা বলেন, পাট খাতের লোকসানের পেছনে রয়েছে মূলত বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাট কেনায় অনিয়ম, চুরি ও অব্যবস্থাপনা। আড়াই লাখ টাকার পাট কিনে একেকজন ৫০ হাজার টাকা লাভ করেন কীভাবে, সেই তদন্ত আগে করা হোক আগে।
পাটকল বন্ধ নয়, বরং বিজেএমসিকে ভেঙে দিতে হবে। গঠন করতে হবে একটি অন্তবর্তীকালীন পরিচালনা পষর্দ।
মূলপত্রে বলা হয়, দরকার হচ্ছে বিজেএমসির বিদ্যমান কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। ২৫টি পাটকল পরিচালনার প্রয়োজনে সংস্থাটির মাথাভারী প্রশাসন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও পাট কেনায় দুর্নীতির কারণে ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্প লোকসানিতে পরিণত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেখা গেছে, পাটের মৌসুম শুরুর আগে পাটকলগুলোকে টাকা দেওয়া হতো না। দেওয়া হতো কয়েক মাস পরে, যখন পাটের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে যায়। এভাবেই পাটকলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাটচাষি থেকে সরাসরি পাট কিনলে এ অবস্থা হতো না। আর বিজেএমসির দুর্নীতিকে আড়াল করে সরকার পাটকলকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর এর দায় চাপিয়েছে শ্রমিকের ওপর।
কথিত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) নাম করে পাটকলকে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, পাটকলে শ্রমিকদের মজুরি ব্যক্তিমালিকানার চেয়ে বেশি এবং মজুরি দিতে গিয়েই এই লোকসান গুনতে হচ্ছে। আপাদমস্তক ব্যবসায়ী মন্ত্রীর হয়তো ইতিহাস জানা নেই, মজুরি কমিশন শ্রমিকদের দীর্ঘ আন্দোলনের অর্জন।
আরও বলা হয়, সরকার হিসাব দিয়েছে ৪৪ বছরে পাটশিল্পে লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিবছর লোকসান ২৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মাত্র। অথচ বিদ্যুতের কুইক রেন্টালকে অলস বসিয়ে রেখে মাসে মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া হচ্ছে।
মূলপত্রে বলা হয়, কোভিড-১৯–এর কারণে প্রায় দেড় কোটি মানুষ যখন কাজ হারিয়ে বেকার, তখন সরকার নিজেই আরও বেকার তৈরি করল। এ ছাড়া দেশের ৫০ লাখ কৃষক পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত, তার কী হবে একবারও ভাবল না। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পাট যখন নতুন করে চাঙা হওয়ার দিকে, তখনই সরকার এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিল।
পাটকল আধুনিকীকরণে মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের যে প্রস্তাব সরকারের উচ্চমহলের টেবিলে দেওয়া হয়েছিল, তা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়।
আলোচনা:
খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, ৯০ শতাংশ শ্রমিক গোল্ডেন হ্যান্ডশেক চান না। চান শুধু ১০ শতাংশ বয়স্করা। তিনি বলেন, এ খাতের আসল গলদ কেনাকাটায়। আড়াই লাখ টাকার পাট কিনে ৫০ হাজার টাকা লাভ করেন কেউ কেউ? এর তদন্ত হোক।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, আত্মঘাতী ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক। সরকারকে এ পথ থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, যদি যন্ত্র বদলানো যায়, পাটের উৎপাদনশীলতা তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব। ৫ থেকে ১০টি পাটকলে সরকার পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়ে দেখুক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা কে? আবার পাটমন্ত্রীও একজন ব্যবসায়ী। ১৪ দলের অংশ ওয়ার্কার্স পার্টি। অথচ এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাদের সঙ্গে একটু আলোচনাও করল না!’
পাট কমিশনের সাবেক সদস্য খালেদ রব বলেন, বাজার একবার চলে গেলে আর ফিরে পাওয়া মুশকিল। উচিত হবে এখন কিছু পাটকল বাছাই করে চালানো আর বাকিগুলোকে ধীরে ধীরে আধুনিকায়ন করা।
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সত্যটা হচ্ছে দুর্নীতি। পাটকল বন্ধ করতে চাওয়ার এ ছাড়া কোনো কারণ নেই। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ যে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় পাটকলগুলোর আধুনিকায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল, এর বাস্তবায়ন জরুরি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, পাটকলের লোকসান পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এখনো এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করলে তিন গুণের কাছাকাছি উৎপাদন হবে।
একজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ না করে শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, তিনি পণ্য সরবরাহ করতেন আদমজী পাটকলে। অন্য কাজ করেছিলেন বলে তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
স্কপের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, রাষ্ট্রীয় ভুলনীতি, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে পাটকলগুলোর এই দশা।
গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের মোস্তফা মনোয়ার বলেন, বিজেএমসির পর্ষদ ভেঙে অন্তবর্তীকালীন পর্ষদ গঠন করতে হবে।
এ ছাড়া বক্তব্য দেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কামরুল আহসান, গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের আরেক নেতা আমানুর রহমান।