>• জনতা ব্যাংকে অনিয়ম
• খেলাপি হয়ে আছে গ্রুপটির পাঁচ প্রতিষ্ঠানই।
• জালিয়াতি, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে টাকা পাচার, মিথ্যা তথ্যসহ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ে বন্ধকি সম্পদ বিক্রির জন্য নিলাম ডেকেছে জনতা ব্যাংক। এভাবে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা আদায় করতে চায় ব্যাংকটি। নিলামকৃত সম্পদের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাড়ে ১৬ শতাংশ প্লট, সাভার ও হাজারীবাগের জমি, যন্ত্রপাতিসহ কারখানা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরের প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, লেক্সকো লিমিটেড ও রূপালী কম্পোজিট লেদার। এর মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র পরিচালক আবদুল আজিজ। জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার তিনি।
জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখায় গ্রাহক বলতে ক্রিসেন্ট গ্রুপ একাই। গ্লোরি এগ্রো ছাড়া ক্রিসেন্টের অপর পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়েই নিলাম ডেকেছে জনতা ব্যাংক। নিলামের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রিমেক্স ফুটওয়্যারের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টসের ৮৬৪ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজের ১৭০ কেটি টাকা, লেক্সকো লিমিটেডের ৪৩০ কোটি টাকা ও রূপালী কম্পোজিট লেদারের ৮৮৮ কোটি টাকা।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদের গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চেষ্টা করছি দেশের বাইরে থেকে টাকা আনার। গত দুই মাসে সাড়ে ৭ লাখ ডলার এসেছে। চলতি সপ্তাহেও আসার কথা রয়েছে। টাকা এলে জনতা ব্যাংকের সঙ্গে বসব। ব্যাংক তো আমাকে ফেলে দিতে পারবে না।’
যোগাযোগ করা হলে রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ বলেন, ‘রিমেক্স ফুটওয়্যার আমার প্রতিষ্ঠান।’ কেন ব্যাংকের টাকা শোধ করছেন না-এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। মিটিংয়ে আছেন এবং পরে কথা বলবেন জানালেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও বড় শহরে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চামড়াজাত পাদুকা পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। দেশের বাইরে পণ্য রপ্তানি করলেও প্রায় ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ফেরত আনছে না গ্রুপটি। ফলে ব্যাংকের বড় অঙ্কের টাকা আটকে গেছে। আবার সরকার থেকেও প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা নগদ রপ্তানি প্রণোদনা নিয়েছে গ্রুপটি। সব মিলিয়ে ব্যাংক, সরকারি কোষাগার ও দেশের বাইরে আটকে রাখা টাকার পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদ গতকাল এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেছি টাকা আদায়ের জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা দফায় দফায় অঙ্গীকার করেও দেশে টাকা আনতে পারেননি। সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষেই তাঁদের বন্ধকি সম্পদ নিলামে তোলা হয়েছে। টাকা আদায়ে ব্যাংকের হাতে আর কোনো পথ নেই।’
জনতা ব্যাংকের স্থানীয় শাখার মহাব্যবস্থাপক এ নিলাম ডেকেছেন। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আগ্রহীদের নিলামে অংশ নিতে বলা হয়েছে।
জনতা ব্যাংক সূত্র ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাগজে-কলমে ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে হংকং ও ব্যাংককে। সেই রপ্তানি বিল ক্রয় করে গ্রুপটিকে নগদে টাকা দিয়েছে ব্যাংক। অথচ রপ্তানির টাকা ফেরত আসছে না। নগদে নেওয়া টাকাও ফেরত দিচ্ছে না গ্রুপটি। ব্যাংক চাপ দেওয়ায় মাঝেমধ্যে কিছু অর্থ আসছে দুবাই থেকে। যদিও আমদানিকারক দেশ থেকেই টাকা আসার কথা। এসব তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সরকার থেকে নেওয়া নগদ সহায়তার টাকা দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে গ্রুপটি।
এসব অনিয়মের কারণে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখার বৈদেশিক ব্যবসার লাইসেন্স (এডি লাইসেন্স) স্থগিত করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে গত জুলাইয়ে ক্রিসেন্টের সব প্রতিষ্ঠানের ঋণ দিলকুশার স্থানীয় শাখায় স্থানান্তর করেছে ব্যাংকটি। এদিকে ভুয়া রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা দেওয়ায় জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে আরও ৪০৮ কোটি টাকা কেটে সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট গ্রুপের এমন অনিয়ম শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আর ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে তিন বছর চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে শাখার কর্মকর্তারা। শাখার কয়েকজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হলেও প্রধান কার্যালয়ের জড়িতরা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হওয়ায় গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। এতে জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকটির লোকসান ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।