২ রুপি থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা

বাবার পকেট থেকে ১৭ রুপি নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন। রেখে যান ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। সন্তানেরা সেটাকে ১৪ হাজার কোটিতে উন্নীত করেছেন।

আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন

ব্যবসা শুরু হয়েছিল ২ রুপি ৩০ পয়সা দিয়ে। কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে নিলামে কমলালেবু কিনে হাওড়া স্টেশনে বিক্রি। মুনাফা ৩০ পয়সা। তখন বয়স ১১ কি ১২ বছর। পরের ৬৫ বছর তাঁর ব্যবসায়ী জীবন। দুই রুপির ব্যবসাকে উন্নীত করেছেন পাঁচ হাজার কোটি টাকায়। প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আকিজ গ্রুপকে। তিনি সেখ আকিজ উদ্দিন, খুলনার ফুলতলা থেকে উঠে আসা বাংলাদেশি শিল্পপতি।

আকিজ উদ্দিনের জন্ম ১৯২৯ সালে। মৃত্যু ২০০৬ সালে। মারা যাওয়ার পর দেখা গেল, তাঁর নিজের সম্পদ আসলে সামান্য। সবকিছুই নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির, সেগুলোর মালিক তাঁর সন্তানেরা। নিজের ‘ট্রেডমার্ক’ পোশাক ছিল সাদা পাঞ্জাবি, সঙ্গে মোটা ফ্রেমের চশমা। জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, বিলাসিতার বদলে ছিল পরিমিতিবোধ। প্রথম দিকে ভেসপা (দুই চাকার মোটরযান) চালাতেন। ১৯৭৭ সালের পর নিজের জন্য কোনো গাড়ি কেনেননি। বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হলেও সন্তানদের দিয়েছেন পরিমিত জীবনযাপনের দীক্ষা।

সেখ আকিজ উদ্দিনের ছেলে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘বাবা ছিলেন ধনী কোম্পানির গরিব মালিক। আমরাও যে খুব বিলাসী জীবন যাপন করি, তা–ও নয়। বাবা আমাদের সম্পদকে দায়িত্বের সঙ্গে নিতে শিখিয়েছেন।’

বাড়ির পাশের রেলস্টেশন থেকে অজানার উদ্দেশে ট্রেনে উঠে বসলেন আকিজ। ট্রেনের শেষ গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া স্টেশন। আকিজকে সেখানেই নামতে হলো। তিন দিন কাটল স্টেশনেই। ক্ষুধা মিটল দুই পয়সার ছাতুতে।

আকিজ গ্রুপের কার্যালয় ঢাকার তেজগাঁওয়ে। ১৯ নভেম্বর দুপুরে সেখানে গিয়ে কথা হয় বশির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বাবার মুখে শোনা তাঁর (আকিজ উদ্দিন) কৈশোরের দুরন্তপনা, বাড়ি ছেড়ে পালানো, ব্যবসা শুরু, কয়েক দফা নিঃস্ব হওয়া, আবার ঘুরে দাঁড়ানো, আকিজের ব্যবসার বিস্তৃতি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বললেন। পাশাপাশি জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের (জেটিআই) কাছে তামাক ব্যবসা বিক্রির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে কী করেছেন, তা–ও জানালেন।

বাড়ি ছাড়েন ১৭ রুপি নিয়ে

খুলনার ফুলতলা উপজেলার মধ্যডাঙ্গা গ্রামের সেখ মফিজ উদ্দিন ও মতিনা বেগম দম্পতির সন্তান আকিজের পড়াশোনায় কোনো মনোযোগ ছিল না। বিদ্যালয়ে যেতেন, তবে তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল দুরন্তপনায়। স্কুল পালানো ছিল নিয়মিত ঘটনা। রাগ করে বাবা একদিন আকিজকে শাসন করলেন। অভিমানে কিশোর আকিজ ঘর ছাড়লেন বাবার পকেট থেকে ১৭ রুপি নিয়ে।

বাড়ির পাশের রেলস্টেশন থেকে অজানার উদ্দেশে ট্রেনে উঠে বসলেন আকিজ। ট্রেনের শেষ গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া স্টেশন। আকিজকে সেখানেই নামতে হলো। তিন দিন কাটল স্টেশনেই। ক্ষুধা মিটল দুই পয়সার ছাতুতে।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তবে কলকাতার জীবনযাত্রা স্বাভাবিকই ছিল। একদিন হাঁটতে হাঁটতে আকিজ গেলেন জাকারিয়া স্ট্রিটে। দেখলেন, রাস্তার ওপরই নিলামে কমলালেবু বিক্রি হচ্ছে। কিছু না বুঝেই নিলামে অংশ নিয়ে ২ রুপি ৩০ পয়সায় দুই ঝুড়ি কমলালেবু কিনে ফেললেন। সেই কমলালেবু হাওড়া স্টেশনে নিয়ে বিক্রি করলেন। তখন হাওড়া ব্রিজ তৈরির কাজ চলছিল। দুই ঝুড়ি কমলালেবুতে মুনাফা হলো ৩০ পয়সা।

আকিজ ভাবলেন, বাহ্​! বেশ ভালো তো। এরপর নিয়মিত ফল কেনাবেচার ব্যবসায় জড়িয়ে যান তিনি। অল্প দিনেই কিশোর আকিজ পুরোদস্তুর ফল ব্যবসায়ী হয়ে যান। নাম ছড়িয়ে পড়ে সেখ আকিজ উদ্দিনের। ফল ব্যবসার কাজেই ভারতের বোম্বে (এখন মুম্বাই) ও আফগানিস্তানে যাতায়াত করতে থাকেন নিয়মিত।

সেখ বশির উদ্দিন এখন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

দেশভাগের পর ফেরা

বাবার পকেট থেকে টাকা নিয়ে পালানোর পর বছর দশেক চলে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। দেশও ভাগ হয়ে গেছে, ভারত থেকে আলাদা হয়ে তৈরি হয়েছে পাকিস্তান। এর মধ্যে বাবা-মা মারা গেছেন। আকিজ উদ্দিন ভাবলেন, এবার নিজের দেশে ফেরা দরকার।

বশির উদ্দিন বলেন, বাবা দেশে ফেরেন ১৯৪৯ সালের দিকে। তত দিনে তাঁর হাতে এক থেকে দুই লাখ রুপি পুঁজি জমেছে। তখনকার দিনে সেটা অনেক টাকা।

ফুলতলায় ফিরে আকিজ উদ্দিন ভাবতে শুরু করলেন, কী করবেন। তবে ব্যবসার বাইরে অন্য কিছু তাঁর ভাবনায় ছিল না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তাঁরই কাছের এক বন্ধু বিড়ির ব্যবসা করেন। সেই বন্ধুর ব্যবসায় কিছু পুঁজি খাটালেন। এরপর বাড়ির পাশেই ফুলতলা বাজারে একটি মনিহারি দোকান দেন। দোকানে বিভিন্ন সামগ্রীর পাশাপাশি নিজে বিড়ি তৈরি করে তা বিক্রি করতে শুরু করেন। শুরুতে বানাতেন টেন্ডু পাতার বিড়ি। তত দিনে বিড়ির ব্যবসাও জমে ওঠে। পাটের ব্যবসাও করতে থাকেন আকিজ উদ্দিন। কাজ ছিল, চাষিদের কাছ থেকে পাট কিনে পাটকলে বিক্রি করা। এভাবেই একের পর এক ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী আকিজ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। ১০ দিন তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি। পরিবার ধরেই নিয়েছিল, তিনি আর বেঁচে নেই।

সীমান্তে প্রথম কারখানা

আকিজ উদ্দিনের পাতার বিড়ির ব্যবসা যখন জমজমাট, তখন টান পড়ে পাতায়। টেন্ডু পাতা আমদানি হতো ভারত থেকে। সরবরাহ সহজ করতে যশোরের নাভারনে স্থাপন করেন প্রথম বিড়ির কারখানা, ১৯৫৩ কি ৫৪ সালে। বিড়ির ব্যবসার পাশাপাশি পাটের ব্যবসাও বেশ ভালো চলছিল। ষাটের দশকে শুরু করেন পাট রপ্তানি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাট, বিড়ি ও রাখি মালের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন আকিজ উদ্দিন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী আকিজ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। ১০ দিন তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি। পরিবার ধরেই নিয়েছিল, তিনি আর বেঁচে নেই। এ কারণে বাড়ির আশপাশের জঙ্গলে গোপনে লাশের সন্ধানও করেন স্বজনেরা। কিন্তু পরিবারের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে ১০ দিন পর তিনি ফিরে আসেন।

কীভাবে, সেটা জানান বশির উদ্দিন। তিনি বলেন, তখন পাকিস্তানি বাহিনী মানুষ ধরে ধরে মেরে ফেলত। এটা করতে তারা সংক্ষিপ্ত বিচারের নামে একটি ব্যবস্থা চালু করেছিল। আফগানিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত থেকে পশতু ভাষা শিখেছিলেন বাবা। পাকিস্তানি বাহিনী যখন তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তখন তিনি পশতু ভাষায় সেনাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আকিজের ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে। যুদ্ধের পরপরই এক বিদেশি মালিকের কাছ থেকে খুলনায় অবস্থিত এসএএফ ট্যানারি কিনে নেন আকিজ উদ্দিন। একটি তেলের মিল, ইটভাটা ও মুদ্রণের কারখানাও ছিল।

স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ব্যবসার প্রয়োজনে খুলনা ও যশোর ছেড়ে একেবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭৭ সালে সরকারের কাছ থেকে ঢাকা টোব্যাকো নামের তামাকজাত পণ্যের মিল কিনে নেন। নব্বইয়ের দশকে একের পর এক ভারী শিল্পের কারখানা করেন। গড়ে তোলেন আকিজ গ্রুপ।

দুবার নিঃস্ব

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি ফুলতলায় আকিজ উদ্দিনের মনিহারি দোকানটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন তাঁর সব সঞ্চয় ছিল দোকানে। তিনি নিজেও ভেতরে ছিলেন। কোনোরকমে বের হতে পারলেও সঞ্চয় সব পুড়ে যায়। কিন্তু কয়েক দিন পরেই দোকানটি আবার চালু হয়। বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা আকিজ উদ্দিনের দোকানে পণ্য পাঠিয়ে দেন।

বাবার সঙ্গে প্রতারণা করা ব্যক্তি কয়েক বছর পর একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সাধারণত আমাদের বাড়িতে বাইরের কারও আসা নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে ওই লোক আসার পর বাবা তাঁকে বসিয়ে মাকে খাবার দিতে বলেন।
সেখ বশির উদ্দিন এখন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বশির উদ্দিন বলেন, সবাই বাবাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তাঁরা জানতেন, বাবা কখনো টাকা মেরে চলে যাবেন না। তাই বিপদের দিনে সবাই এগিয়ে এলেন। ব্যবসা আবার শুরু হলো।

আকিজ উদ্দিনের আরেকবার সব হারানোর গল্পটাও বলেন বশির উদ্দিন। তিনি জানান, পাট রপ্তানির জন্য আকিজ উদ্দিন একজন ইংরেজি জানা ব্যক্তিকে অংশীদার হিসেবে নেন। তিনিই রপ্তানির প্রক্রিয়াগত কাজ করতেন। টাকাপয়সার হিসাব রাখতেন। একসময় ওই অংশীদার বলেন, আকিজ উদ্দিন আর কিছুর মালিক নন। তাঁর কিছুই নেই।

বশির উদ্দিন বলেন, ‘বাবার সঙ্গে প্রতারণা করা ব্যক্তি কয়েক বছর পর একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সাধারণত আমাদের বাড়িতে বাইরের কারও আসা নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে ওই লোক আসার পর বাবা তাঁকে বসিয়ে মাকে খাবার দিতে বলেন।’ তিনি বলেন, ‘মা এ নিয়ে বাবার সঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। জবাবে বাবা বলেছিলেন, “তোমার বাড়িতে এসেছে, এর চেয়ে বেশি কী চাও।”’

সেখ বশির উদ্দিন এখন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

শুরু থেকেই ব্র্যান্ডিং

আকিজ উদ্দিন যখন বিড়ি উৎপাদন করতেন, তখন বাজারে অনেক বিড়ি ছিল। এখনকার মতো প্যাকেট, মুদ্রিত নাম ছিল না। ছিল না কোনো ব্র্যান্ড। কিন্তু আকিজের বিড়ি সবাই চিনত। কারণ, বিড়ির সঙ্গে একটু লাল সুতা বেঁধে দিয়ে তিনি নিজের পণ্যকে আলাদা করতেন।

বশির উদ্দিন বলেন, তখন পণ্যের উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি ছিল। তাই তৈরি করলেই বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু বাবা বুঝতেন, একটা সময় সেটা থাকবে না। তাই আলাদা পরিচিতি ছাড়া উপায় নেই। ‘শুরু থেকেই বাবা ব্র্যান্ডিংয়ে নজর দিয়েছিলেন, মানের দিকে নজর দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আকিজ যে পণ্য বানাবে, তা মানের দিক দিয়ে বাজারের শ্রেষ্ঠ হতে হবে।’—যোগ করেন বশির উদ্দিন। তিনি আরও জানান, আকিজ উদ্দিন পাইকারি বাজারকেন্দ্রিক ব্যবসার বদলে নিজস্ব সরবরাহব্যবস্থা তৈরির ওপর জোর দিতেন। এতে তাঁর খরচ বেশি পড়ত। কিন্তু সেটা ছিল ব্যবসার শক্তি। সেই কৌশলটি আকিজ এখনো ধরে রেখেছে।

এখন আকিজের সিমেন্ট, সিরামিক, খাদ্যপণ্য, বস্ত্রকল, প্লাস্টিক, পাট, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, পার্টিকেল বোর্ড, জাহাজে পণ্য পরিবহন, চা-বাগান, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। গ্রুপের অধীনে রয়েছে ২৬টি কোম্পানি। বশির উদ্দিন বলেন, বাবার সময়ই বেশির ভাগ কারখানার যাত্রা শুরু। তিনি মারা যাওয়ার সময় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ছিল। এখন সেটা ১৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কাজ করেন ৩৫ হাজার কর্মী।

আকিজ উদ্দিনের ১৫ জন সন্তান। ১০ ছেলে ও ৫ মেয়ে। আকিজ উদ্দিনের ছেলেরাই শুধু ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে ১০ সন্তানের মধ্যে ব্যবসার ভাগ করে দেন আকিজ উদ্দিন নিজেই। বড় ছেলে সেখ মহিউদ্দিন চিকিৎসক, তিনি আদ্–দ্বীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় ছেলে সেখ মমিন উদ্দিন সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি ট্যানারি, চামড়াসহ বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। তৃতীয় ছেলে সেখ আমিন উদ্দিনের তথ্যপ্রযুক্তি, গাড়িসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। চতুর্থ ছেলে সেখ আফিল উদ্দিন সাংসদ। পঞ্চম ছেলে সেখ আজিজ উদ্দিনের পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট খাত, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। সেখ নাসির উদ্দিন, সেখ বশির উদ্দিন, সেখ জামিল উদ্দিন, সেখ জসিম উদ্দিন ও সেখ শামীম উদ্দিন একসঙ্গে ব্যবসা করেন। সব ভাইয়ের ব্যবসা মিলিয়ে আকার অনেক বড়।

সেখ আকিজ উদ্দিনের ভেসপাটি আকিজ গ্রুপের কার্যালয়ের সামনে সাজিয়ে রাখা আছে

১২,০০০ কোটি টাকা কী করেছেন

২০০০ সাল পর্যন্ত আকিজ গ্রুপের ব্যবসার অর্ধেকটা জুড়েই ছিল তামাকসংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসা। ২০১৮ সালে জাপান টোব্যাকোর কাছে তামাক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বিক্রি করে দেয় আকিজ। দাম পায় প্রায় ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেই টাকা দিয়ে কী করেছে আকিজ?

ভবিষ্যতে আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের যে পরিকল্পনা, তার সঙ্গে তামাক মেলে না; বরং ব্যবসার ভাবমূর্তি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই ছেড়ে দেওয়া।
সেখ বশির উদ্দিন এখন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বশির উদ্দিন বলেন, টাকাটি দীর্ঘ সময় ধরে ধাপে ধাপে দেবে জাপান টোব্যাকো। টাকার একটা অংশ যাবে সরকারের কর হিসেবে। যে টাকা পাওয়া গেছে, তা থেকে কর দিয়ে বাকিটা নতুন ব্যবসা অধিগ্রহণ ও বর্তমান ব্যবসার সম্প্রসারণে ব্যয় করেছে আকিজ। যেমন ৭২৫ কোটি টাকায় তারা জনতা জুট মিল কিনেছে। মালয়েশিয়ায় একটি এমডিএফ বোর্ডের কারখানা অধিগ্রহণ করেছে। দেশে তৈজসপত্র ও কাচের কারখানায় বিনিয়োগ করেছে।

তামাক ব্যবসা কেন ছেড়ে দেওয়া, তার একটা কারণও জানান বশির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের যে পরিকল্পনা, তার সঙ্গে তামাক মেলে না; বরং ব্যবসার ভাবমূর্তি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই ছেড়ে দেওয়া।’

করোনাকালে আকিজ গ্রুপ

করোনাকালে আকিজ গ্রুপ কোনো কর্মী ছাঁটাই করেনি। বেতন-ভাতায় কোনো কাটছাঁট হয়নি। শুরুতেই কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কোনো চিন্তা নেই; বরং আকিজ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

বশির উদ্দিন বলেন, ‘বাবা সব সময় কর্মীদের ভালোবাসতেন। ১৯৮৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করে আমি বাবার ব্যবসায় যোগ দিই। পদ ছিল স্টেশনারি খরিদকারী। তখন আমার মূল্যায়ন আলাদা কিছু ছিল না। কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ
হলে বাবা সব সময় কর্মীর পক্ষ নিতেন।’ বশির উদ্দিন বলেন, ‘অন্যান্য কর্মীর মতো আমারও বার্ষিক কাজের মূল্যায়ন হতো। সেই অনুযায়ী বেতন বাড়ত। ছেলে হিসেবে আলাদা কোনো সুবিধা
ছিল না।’

এই সুযোগে বশির উদ্দিন সম্পর্কেও কিছু জেনে নেওয়া হলো। তিনি বললেন, ম্যাট্রিক পাস করে ব্যবসায় ঢুকে তিনি পরে তেজগাঁও কলেজের নৈশ শাখা থেকে বিকম পাস করেন। তিনি বলেন, ‘বাবাই আমার শিক্ষক। যা কিছু শিখেছি, তাঁর কাছ থেকেই।’

আকিজ গ্রুপ কয়েক দশক ধরে বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বড় হয়েছে। করোনার শুরুর দিকে ব্যবসা কিছুটা গতি হারিয়েছিল, তবে এখন আগের পর্যায়ে ফিরেছে। করোনার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে কীভাবে, তার একটা ব্যাখ্যা আছে বশির উদ্দিনের কাছে। তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, করোনা—যা-ই আসুক না কেন, কাজ করতেই হয়। তাই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই।

তা-ই তো। আট দশক আগে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে সেখ আকিজ উদ্দিনের জীবনসংগ্রামই তাঁকে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বানিয়েছে। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তেজগাঁওয়ে আকিজ ভবনের সামনে সেই ভেসপাটি সাজিয়ে রাখা, যেটি সেখ আকিজ উদ্দিন চালাতেন। শুধুই কি স্মৃতি, বশির উদ্দিনের জবাব, বাবার মূল্যবোধেই আকিজ চলছে।

একনজরে সেখ আকিজ উদ্দিন ও আকিজ গ্রুপ

জন্ম ১৯২৯ সালে, মৃত্যু ২০০৬ সালে।

কিশোর বয়সে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে কমলালেবু বিক্রি করে ব্যবসা শুরু।

এখন আকিজের সিমেন্ট, সিরামিক, খাদ্যপণ্য, বস্ত্রকল, পাট, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, পার্টিকেল বোর্ড, প্লাস্টিক, জাহাজে পণ্য পরিবহন, চা-বাগান, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে।

গ্রুপের অধীনে রয়েছে ২৬টি কোম্পানি। কাজ করেন ৩৫ হাজার কর্মী।