২৫৫০ কোটি টাকা নিয়ে রশি–টানাটানি

আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে চায় বিশ্বব্যাংক। এই অর্থ কারা খরচ করবে, তা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টানাটানি।

ঢাকাসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে কে থাকবে, তা নিয়ে এখন স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি-টানাটানি চলছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাটি বাংলাদেশের নগর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ৩০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চায়, যা স্থানীয় মুদ্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। এ টাকা কার মাধ্যমে খরচ হবে, সেটি নিয়েই দেখা দিয়েছে জটিলতা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক যুগে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে নগর স্বাস্থ্যসেবায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। বিষয়টি খোদ স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন। তাঁরাও মানেন, শহরের দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে কিংবা স্থানীয় কোনো ফার্মেসিতে যেতে হয়।

গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, যার আওতায় রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অন্যদিকে ২০০৯ সাল থেকে সিটি করপোরেশন আইনের মাধ্যমে নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় নগর স্বাস্থ্যসেবা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে নগর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক যুগে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে নগর স্বাস্থ্যসেবায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। বিষয়টি খোদ স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন। তাঁরাও মানেন, শহরের দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে কিংবা স্থানীয় কোনো ফার্মেসিতে যেতে হয়।

এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক ঢাকাসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ৩০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা দিতে চায়, যা দেশীয় মুদ্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। এ নিয়ে দুই মাস ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক প্রধান ড্যানড্যান চেন। এসব বৈঠকে তাঁরা জানতে চেয়েছেন কোন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নগর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে।

দুই মন্ত্রণালয় চাইলে সহজেই শুধু দৃষ্টিভঙ্গি বদলে সমস্যাটির সমাধান করতে পারে। কারণ, এখানে কাজের পরিধি এত বিশাল যে দুই মন্ত্রণালয়ই কাজ করতে পারে।
হোসেন জিল্লুর রহমান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গ্রামের মতো শহরেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে চায়। কিন্তু বিদ্যমান সিটি করপোরেশন আইনে সে সুযোগ নেই। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা আইন সংশোধন করতে হবে। তা করা সম্ভব না হলে বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকা ১৭টি সরকারি ফার্মেসির (জিওডি) কার্যক্রম বাড়িয়ে সেবা দেওয়া যেতে পারে। অথবা ঢাকায় বড় যেসব হাসপাতাল আছে, সেগুলোর পাশে আলাদা অবকাঠামো নির্মাণ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়।

অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য তারা অবকাঠামো নির্মাণ করে দেবে। আর চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কিছুতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে যাওয়া ঠিক হবে না বলে মত দিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে এখন দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সারা পৃথিবীতে সিটি করপোরেশন সড়কবাতি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করার মতো নগর স্বাস্থ্যসেবাও দিয়ে থাকে। আইনে এসব কাজ করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বড় বড় হাসপাতাল, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। তাদের নগর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সুযোগ নেই।

■ নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাদের সেবা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ■ গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখন তারা নগরে কাজ করতে চায়।

হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘গত এক যুগে নগর স্বাস্থ্যসেবার ততটা উন্নতি হয়নি, এটা ঠিক। তবে এ নিয়ে কাজ চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা ওয়ার্ডভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ করে দেব। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যসেবা দেবে।’

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব কার কাছে থাকবে, এটি ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। আমলাতন্ত্র এমন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। তিনি আরও বলেন, দুই মন্ত্রণালয় চাইলে সহজেই শুধু দৃষ্টিভঙ্গি বদলে সমস্যাটির সমাধান করতে পারে। কারণ, এখানে কাজের পরিধি এত বিশাল যে দুই মন্ত্রণালয়ই কাজ করতে পারে। নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিয়ে গত এক যুগে কী করতে পেরেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

তথ্য বলছে, ১৯৯৮ সাল থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে পরিচালিত এ প্রকল্পের আওতায় তেমন সুফল মেলেনি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীতে দুই কোটি মানুষের বসবাস। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা দিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্য ইউনিট নেই। কারিগরি জ্ঞান, অবকাঠামো ও জনবল নেই। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য পৃথক আর্থিক খাত নেই।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হেলাল উদ্দিন বলেন, নগরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়াতে চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে এখানে আইনকানুনের জটিলতা আছে। সে জন্য নগর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।