করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার ও কাজ হারানো শ্রমিকদের সহায়তা দিতে তৈরি করা হয় ২,৭৫০ কোটি টাকার তহবিল। কিন্তু বিতরণ হয়নি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
বরাদ্দ ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে দেওয়া হয়েছে ৯১২ কোটি টাকা।
ফেরত এসেছে ১০১ কোটি টাকা।
শ্রমিকদের সহায়তা তহবিল দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা।
করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ গরিব পরিবারকে নগদ সহায়তা দিতে বাজেটেই টাকা রাখা আছে। কারখানা থেকে হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়া মানুষদের সহায়তায় এসেছে ভালো অঙ্কের বিদেশি অনুদানও।
৫০ লাখ পরিবারের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৯১২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৭ হাজার ৮৭২ পরিবারের কাছে আড়াই হাজার করে টাকা পৌঁছানো গেছে। এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা ফেরত এসেছে। শেষ পর্যন্ত দেওয়া হলো ৮১১ কোটি টাকা। ৪৩৯ কোটি টাকা দিতে পারেনি সরকার। এ ছাড়া শ্রমিকদের প্যাকেজে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার দিতে পেরেছে ৫ কোটি টাকা। এই দুই তহবিল মিলিয়ে সরকারের কাছেই থেকে গেছে ১ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে নতুন বিপত্তির কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে, অর্থ পাঠানো হলেও ৪ লাখ ২ হাজার ১৬৮টি পরিবারের কাছে কোনো টাকা পৌঁছায়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে চলে যাওয়া ১০১ কোটি ১৫ লাখ টাকা পড়ে আছে বিকাশ, নগদ, রকেট, শিউরক্যাশ—এই চার মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের কাছে। তাদের কাছ থেকে টাকাগুলো ফেরত নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন গত বছরের ১৪ মে। এর আগে ৫০ লাখ পরিবারের তালিকা তৈরি করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা মিলে। অর্থ বিতরণ শুরু হওয়ার পর দেখা যায়, প্রায় পুরো তালিকাই ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ যাঁরা টাকা পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের বদলে তালিকায় ঢুকে পড়েছেন তুলনামূলক সচ্ছল মানুষেরা।
প্রথমবার হওয়াতে এটা নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। বেশির ভাগ লোকই পেয়েছেন।আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থমন্ত্রী
অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে গত বছরের আগস্টে অর্থ বিভাগের এক অবস্থানপত্রে ধরা পড়ে। এরপর ৫০ লাখের তালিকা থেকে ১৪ লাখ ৩৩ হাজার জনকে বাদ দেয় সরকার। কাজটির সঙ্গে যুক্ত ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল শনিবার রাতে এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমবার হওয়াতে এটা নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। বেশির ভাগ লোকই পেয়েছেন। প্রক্রিয়াটি নিয়ে এখন কাজ চলছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়।’ এর হালনাগাদ পরিস্থিতি জানতে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থসচিব এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে গত রাতে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা দিয়ে প্রথম আলোকে জানান। দেশে গরিব মানুষ থাকা সত্ত্বেও ১১ মাসেও কেন কাজটি করা গেল না—এ নিয়েও কোনো মন্তব্য করেননি অর্থসচিব।
একদিকে টাকা পড়ে আছে, অন্যদিকে বাড়ছে অভাবী মানুষের হাহাকার। আমলাতন্ত্রের দুর্বলতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দায়িত্বে থাকা আমলারা সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারেননি, তালিকা তৈরিতে অনিয়ম করেছেন এবং যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতেও ব্যর্থ হয়েছেন।
রাজশাহী মহানগর কৃষক লীগের সহসভাপতি মুর্শিদ কামাল শহরের একজন ধনী ব্যক্তি। সহায়তা পাওয়ার তালিকায় তাঁর নামও ছিল। বিভাগীয় শহরটির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি পরিবার পেয়েছে আড়াই হাজার টাকা, যে পরিবারের মালিকের তিনতলা বাড়ি রয়েছে এবং যিনি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসবাস করেন। এ ছাড়া একটি গ্রামের ৪০০ জনের তালিকার মধ্যে ৪ জন ছাড়া কেউ ওই গ্রামের বাসিন্দাই নন বলে জানা গেছে। এটি এমনই তালিকা হয়েছে যে এতে এক লাখের বেশি লোক আছেন, যাঁরা অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকেও সুবিধা পাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রায় ৩ লাখ ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের নাম রয়েছে একাধিকবার। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিপরীতে মোবাইল সিম নিবন্ধিত না থাকা ব্যক্তি রয়েছেন ৬ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৪ জন। এ ছাড়া একই ব্যক্তির তথ্য একাধিকবার থাকাসহ সরকারের পেনশনভোগী, সরকারি কর্মচারী, ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের মালিকেরাও রয়েছেন।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চার এমএফএসের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরিবারের কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে নগদ। আর সবচেয়ে কম দিয়েছে শিউরক্যাশ। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পৌঁছেছে প্রায় ৯০ হাজার পরিবারের কাছে। আর সবচেয়ে বেশি ৭ লাখ ২২ হাজার জন বা ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশ সহায়তা পেয়েছেন ঢাকা বিভাগ থেকে। আর সবচেয়ে কম ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৩২ জন বা ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ পেয়েছেন বরিশাল বিভাগ থেকে।
টাকা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ লাখ ৫৩ হাজার জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর। আর ২৪ হাজার জনের বয়স ৮০ বছরের বেশি। এ ছাড়া ১৮ লাখ দিনমজুর, সাড়ে ৪ লাখ কৃষক, সাড়ে ৩ লাখ শ্রমিক, সোয়া ২ লাখ গৃহকর্মী, পৌনে ২ লাখ মোটরশ্রমিক এবং সোয়া ৫ লাখ অন্যান্য পেশার মানুষ টাকা পেয়েছেন।
কোভিডের এক বছরে তাহলে কী শিখলাম? এখন যদি একটি সুনামিতে আবার ৫০ লাখ লোককে সাহায্য দিতে হয়, আমরা কি পারব।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
এদিকে করোনায় কাজ হারানো শ্রমিকদের তিন মাস তিন হাজার করে টাকা দেওয়ার জন্য ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার সমান ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মানির সরকার। সরকার আরও কিছু যোগ করে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। শ্রম অধিদপ্তর তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে গত অক্টোবর থেকে। ১০ লাখ শ্রমিককে সহায়তা দেওয়ার চিন্তা থেকে তার আগে একটি নীতিমালাও জারি করা হয়। ছয় মাসে টাকা খরচ হয়েছে ৫ কোটি।
এখানেও টাকা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি চিহ্নিত করতে পারছে না সরকার। তালিকা নেই, ফলে টাকাও পাচ্ছেন না কেউ। এই টাকাও ব্যাংক বা এমএফএসের মাধ্যমে দেওয়ার কথা। নীতিমালায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক নির্ধারণে আটটি মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, অর্থ পাবেন রপ্তানিমুখী পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কর্মরত শ্রমিক, শারীরিকভাবে অক্ষম, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধাবঞ্চিত সন্তান জন্মদানকারী, করোনা বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত, শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাওয়ার শর্তের আওতার বাইরে থাকা শ্রমিক, ছাঁটাই হওয়া ও বর্তমানে কর্মহীন, লে-অফ হওয়া কারখানার কর্মহীন শ্রমিক এবং গত বছরের ৮ মার্চের পর চাকরি হারানো শ্রমিক।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নীতিটিই করা হয়েছে ভুলভাবে। এখন তিনটি উপায়ে টাকাগুলোর সদ্গতি করা যায়। যেমন দেনার দায়ে জর্জরিত বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া, বন্ধ না হলেও শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছে না—এমন কারখানাগুলোকে সহায়তা করা এবং সমিতির সদস্য নয়—এমন কারখানাগুলোর সাহায্যে এগিয়ে আসা।
তালিকা তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কারখানা ও চারটি সমিতির। সমিতিগুলো হচ্ছে পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও দেশের একটি বড় সমস্যা। এটি প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণা ছিল। সে অনুযায়ী টাকাও বরাদ্দ রাখা আছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে প্রায় এক বছর ধরে ৫০ লাখ পরিবারের কাছে সহায়তাটা পৌঁছানো গেল না—এটা খুবই দুঃখজনক।’ কোভিডের এক বছরে তাহলে আমরা কী শিখলাম? এখন যদি একটি সুনামিতে আবার ৫০ লাখ লোককে সাহায্য দিতে হয়, আমরা কি পারব?—এই প্রশ্ন রাখেন আহসান এইচ মনসুর।