তাদের ব্যবসা যেনতেন কিসিমের ছিল না। তা আকারে যেমন বড় ছিল তেমনি সুনাম–সুখ্যাতিতেও ভরপুর ছিল। বিশ্বজোড়া ব্যবসা থেকে দুহাত ভরে শত শত কোটি ডলার আয় করত। বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকের কাছে তারা ব্যাপক সমাদৃত ছিল। কিন্তু তাদের ছিল না শুধু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আর যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা ও দূরদর্শিতা। অন্যদিকে ব্যবসায়িক অসততা ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা জোরালো হয়ে উঠছিল। পরিণতিতে কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর যেন কোনো উপায়ই খোলা থাকল না এসব কোম্পানির সামনে।
এ রকম সাতটি বৈশ্বিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পতনের কাহিনি বলা হচ্ছে এখানে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—ক্যামেরা ও ফিল্ম তৈরির ব্র্যান্ড কোডাক, বিনিয়োগ কোম্পানি লেহম্যান ব্রাদার্স, বিমান পরিবহন সংস্থা প্যান আমেরিকান এয়ারলাইনস (প্যান অ্যাম), জ্বালানি কোম্পানি এনরন, চেইন বুকশপ বর্ডারস, ভিডিও ভাড়া দেওয়ার প্রতিষ্ঠান ব্লকবাস্টার এবং খেলনা বিক্রেতা টয়জ আর ইউ।
একসময় ক্যামেরা ও ফিল্ম তৈরির কোম্পানি বলতেই মানুষ ভাবত কোডাক ব্র্যান্ডের কথা। কারণ, ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিই ছবি তোলার সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোম্পানিটি ক্যামেরা ও ফিল্মের ব্যবসা করে বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি লাভ করেছিল। ডিজিটাল ক্যামেরার উন্নয়নেও কোডাককে পথিকৃৎ বলা হয়, যা ১৯৭০-এর দশকে নিয়ে এসেছিল কোম্পানিটি। তা সত্ত্বেও কোডাকের ব্যবসায়িকভাবে মার খাওয়ার জন্য ডিজিটাল ক্যামেরার আরও উৎকর্ষ সাধন ও বিক্রিতে জোর না দেওয়াকেই দায়ী করা হয়।
কোডাকের যখন পতন শুরু হয় তখন তারা কিনা ফিল্ম উন্নয়নে মনোযোগ দিতে শুরু করে। তত দিনে ফিল্ম প্রায় অচল হয়ে পড়ে। কারণ, এরই মধ্যে পৃথিবীতে স্মার্টফোন এসে গেছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে স্মার্টফোনের দ্রুত উন্নতি ঘটে। ফলে স্মার্টফোনে অনেক শক্তিশালী ফোন সংযোজিত হয়। আর ছবি প্রিন্ট করার প্রয়োজনীয়তাও বলতে গেলে ফুরিয়ে যায়। কারণ, মানুষ এখন অ্যালবামের পরিবর্তে কম্পিউটার, গুগলসহ নানাভাবে ছবি সংরক্ষণ করত পারে। রাখা যায়। ক্রমাগত মন্দার মধ্যে ২০১২ সালে কোডাক নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। ১২৩ বছরের পুরোনো ব্যবসা ছেড়ে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের ব্যবসা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে ৭৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ নেয় কোডাক।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক জ্বালানি কোম্পানি এনরন হারিয়ে গেছে হিসাব নিয়ে জালিয়াতি করার জেরে। ২০০১ সালে কোম্পানিটির জালিয়াতি প্রকাশ পায়। ফলে ওই বছরই কোম্পানিটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিকউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের তদন্তে এই জালিয়াতি ধরা পড়ে। পরে তারা ১৯৯৭ সাল থেকে হিসাব ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানোর কথা স্বীকার করে। সে জন্য এনরনকে করপোরেট কেলেঙ্কারির হোতা বা প্রতীক বলা হয়। আর এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দেউলিয়া কোম্পানি।
২০০৮ সালে শেয়ারহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীরা এনরন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে মামলা দায়ের করে। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি ২৫ বছর হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। এদিকে যেসব ব্যাংক এনরনের হিসাব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিল সেগুলোকেও ৭২০ কোটি ডলার জরিমানা করে দেশটির ফেডারেল কোর্ট।
২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া সাব-প্রাইম ক্রাইসিস খ্যাত বন্ধকি ঋণের সংকট শুধু সেই দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই মন্দার মুখে ঠেলে দেয়। এতে অনেক ব্যাংক, আর্থিক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তবে সবচেয়ে বড় দুর্দশার শিকার হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান লেহম্যান ব্রাদার্স। ১৯৯৪ সাল থেকে লোকসান দিয়ে আসা লেহম্যান ব্রাদার্স বন্ধকি ঋণের চাপ সইতে পারেনি।
ফলে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতে বৃহত্তম দেউলিয়ার ঘটনা। তখন বিশ্বব্যাপী এই কোম্পানির জনবলসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত লেহম্যান ব্রাদার্সের দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার সময় মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে তখন প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
জায়গায় জায়গায় স্টোর বা শাখা খুলে ভিডিও ভাড়া দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করেছিল ব্লকবাস্টার। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্লকবাস্টার তরুণদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে বিশ্বজুড়ে একসময় ব্লকবাস্টারের স্টোর বা শাখার সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে যায়। শনিবার রাতে তরুণদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠত ব্লকবাস্টারের শোরুম। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের করপোরেট মালিকানাধীন কোম্পানি। কিন্তু এরই মধ্যে দেশে দেশে ব্যক্তিমালিকানায় পাড়ায়-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো সিডি-ডিভিডি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা গড়ে উঠতে থাকে। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ে বিনিয়োগ বাড়াতে না পারার কারণেও ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে মনে করা হয়। তবে এটি সবচেয়ে বড় মার খায় নেটফ্লিক্সের আবির্ভাবের পর। অথচ তারা প্রথম দিকে নেটফ্লিক্সকে পাত্তাই দিত না, যেটি পরবর্তীকালে তাদের জন্য কাল হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে ব্লকবাস্টার দেউলিয়া ঘোষিত হয়। আর ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সব শাখা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭০-এর দশকে বিশ্বে বিমান পরিবহনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ছিল প্যান আমেরিকান এয়ারলাইনস, সংক্ষেপে প্যান অ্যাম। কিন্তু পরের দশকেই নামীদামি এই বিমান পরিবহন সংস্থার নামের ভার ও কাজের ধার কমতে থাকে। ওই সময়ে একদিকে বাজার চাহিদার তুলনায় কোম্পানির বিমানবহর বেশ বড় ছিল, অন্যদিকে জ্বালানির দামও দিন দিন বাড়ছিল। এর ওপর কর্তৃপক্ষ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল। সব মিলিয়ে ভরাডুবির দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে কোম্পানিটি।
এমন অবস্থায় কোম্পানির নিউইয়র্কের প্রসিদ্ধ প্যান অ্যাম ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বিক্রি করতে হয়। অব্যাহত লোকসানের মধ্যে ১৯৮৮ সালে প্যান অ্যামের একটি বিমান স্কটল্যান্ডের লকারবিতে বোমা হামলার শিকার হয়। সব মিলিয়ে লোকসান-বিপর্যয়ের ধকল আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি প্যান অ্যাম। পরিণতিতে প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯১ সালে দেউলিয়া ঘোষিত হয় এবং ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয়। অথচ ১৯২৭ সাল থেকে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বিমান সংস্থা।
চেইন বুকশপ বর্ডারস ক্রেতাদের জন্য ক্যাফে খুলে দিয়েছিল, ইন্টারনেট ব্রাউজ করে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী বই, গান ও সিনেমাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য জানার সুযোগও এনে দিয়েছিল। এটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭১ সালে। অথচ এ রকম একটি গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠানই কি না কালের অতলে হারিয়ে গেল।
২০০৯ সালের জুনে এটি যুক্তরাজ্য থেকে ওঠে যায়। দুই বছর পর ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ তখন এটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খুচরা বই বিক্রেতা বা চেইন বুকশপ। ক্রমাগতভাবে বিক্রি কমার পাশাপাশি বইয়ের বাজারে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন, তীব্র প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়ার সুযোগ এবং সুপারমার্কেটগুলোয়ও বই বিক্রির পরিস্থিতিতে বর্ডারস বুক শপের টিকে থাকা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে জেফ বেজোসের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজন অনলাইনে বই বিক্রি শুরু করার কারণে বর্ডারস বুকশপ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের খেলনা বিক্রেতা টয়জ আর ইউএস ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দেউলিয়া ঘোষিত হয়। আর ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠানটির সব স্টোর বা বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য কোম্পানিটির এশিয়া অঞ্চলের স্টোরগুলো বন্ধ করা হয়নি। সেগুলো ফুঙ রিটেইলিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নেয় এবং চালু রাখে। খুচরা পণ্য বিক্রিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কেট হার্ডক্যাসল একবার বিবিসিকে বলেন, ‘টয়জ আর ইউএসের দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হওয়ার ঘটনা ছিল হৃদয় ভাঙার মতো। কারণ, ক্রেতারা তাঁদের সন্তানদের জন্য টয়জ আর ইউর মতো সেরা ব্র্যান্ডের খেলনাই কিনতে চান।’ তিনি মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় অনেকগুলো শাখা খোলার কারণেই মূলত টয়জ আর ইউএস গতি হারায় এবং দেউলিয়া হয়ে যায়।
সূত্র: বিবিসি, গোব্যাংকিংগ্র্যাটস, ইয়াহু।