কয়েক দিন ধরেই রাজধানীর অলিগলির দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বাজারগুলোতে অল্পবিস্তর কিছু মিলছে। কারওয়ান বাজারে দু-একটি ছাড়া অন্য দোকানগুলোতে আজ রোববার সকালেও সয়াবিন তেল ছিল না। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়। তার কারণ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান।
অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তারের নেতৃত্বে বেলা ১১টার পর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে অভিযান শুরু হয়। মার্কেটের নিচতলার মুদিদোকানে তেলের সংকট দেখে তিনতলায় ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে যান এই কর্মকর্তা। একের পর এক গুদাম খুলতেই বেরিয়ে আসে কার্টনভরা সয়াবিন তেল। সেই তেল নিচতলার মুদিদোকানিদের কাছে বিক্রি করা হয়। আর সয়াবিন তেল মজুত করায় তিন ব্যবসায়ীকে ২ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর নামের তেলের এক ডিলারের গুদামে ৫ লিটারের ১০০ কার্টন বা ৪০০ বোতল (মোট ২ হাজার লিটার) সয়াবিন তেল পান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সেই প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সেই অর্থ আদায়ও করা হয়। এ ছাড়া মজুত করা দুই হাজার লিটার সয়াবিন তেল মার্কেটের নিচতলার খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করার নির্দেশ দেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
গুদামে অভিযান শেষে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, ডিলারদের গতকাল শনিবার খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তেল সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা সেটি না দিয়ে আজ মে দিবসের ছুটিতে সুযোগ নিয়ে বাড়তি দামে বিক্রির চেষ্টা করছিলেন। তাই গোডাউনে অভিযান চালিয়ে সব তেল বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আজ থেকে তেল গোডাউনে নিতে পারবেন না ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মার্কেটের নিচ থেকেই খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করতে হবে।
ফাহমিনা আক্তার আরও বলেন, ‘আমরা খুচরা ও পাইকারি বাজারের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানির মিলগেটেও তদারকি করছি। সেখান থেকে প্রতিদিন রেকর্ড পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, বোতলের গায়ে উল্লেখ করা দামের চেয়ে কেউ এক টাকা বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এক হাজারবার অভিযোগ এলে এক হাজারবারই জরিমানা করা হবে। তিনি ভোক্তাদের অধিদপ্তরের হটলাইনে (১৬১২১ নম্বরে) অভিযোগ করতে আহ্বান জানান।
পরে মার্কেটের নিচের খুচরা দোকানে ঘুরে ঘুরে তদারকি করেন ফাহমিনা আক্তার। এ সময় দুই-তিনজন ক্রেতা প্রতিদিন বাজার তদারকি করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা আজ অভিযান চালিয়েছেন বলে তেল কিনতে পেরেছি।’
মঞ্জিল হোসেন তালুকদার নামের এক ক্রেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারওয়ান বাজারের কোনো দোকানে গতকাল (শনিবার) সয়াবিন তেল পাইনি। দুই-একজন ব্যবসায়ী ৫ লিটারের বোতল প্রতি ৫০-১০০ টাকা বাড়তি দাম চেয়েছেন।’
কিচেন মার্কেটের তিনতলায় যখন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান চলছিল তখন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদন নিচের খুচরা দোকানে ঘুরে দেখেন। অধিকাংশ দোকানেই সয়াবিন তেল নেই। দুই-তিনটি দোকানে পুষ্টি, সান ও বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের এক লিটারের কয়েকটি বোতল দেখা যায়। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার পর থেকে দোকানগুলোতে তেল আসতে শুরু করে।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিরাজুল ইসলাম নামের এক খুচরা ব্যবসায়ী বললেন, ‘৭-১০ দিন ধরেই সয়াবিন তেল চাহিদা অনুযায়ী পাচ্ছি না। প্রতিদিন আমার দোকানে কমপক্ষে ৫০ লিটার সয়াবিন বিক্রি হয়। কিন্তু পাই ১০ লিটার। ডিলারদের কাছে তেল এলেও তাঁরা চুপিচুপি বেশি দামে বিক্রি করে দেন।’ তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে এক লিটার ও দুই লিটারের দুই কার্টুন তেল পেয়েছি। এক লিটারের বোতল ১৫৮ টাকা ও ২ লিটারের বোতল ৩১২ টাকায় কিনতে হয়েছে।
বিক্রি করবেন কত টাকায় জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘১ লিটার ১৬০ টাকা ও ২ লিটার ৩১৬ টাকায় বিক্রি করব।’
দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে পূরণ করা হয়। সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে। কেউ কেউ বীজ আমদানি করেও তা ভাঙিয়ে তেল উৎপাদন করে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, এ বছর ১ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে (১ মার্চ-২৮ এপ্রিল) ১ লাখ ৩৭ হাজার টন সয়াবিন তেল বন্দরের কাস্টম বন্ডেড ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস করেছে কোম্পানিগুলো।
আমদানিতে উৎসাহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশে দামের পার্থক্যকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেশি। কিন্তু দেশে সরকার মূল্য সমন্বয় করতে দিচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বশেষ গত ২০ মার্চ বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে। তখন পাঁচ লিটার বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৭৬০ টাকা।
বেলা ১টার দিকে কারওয়ান বাজার থেকে বের হওয়ার সময় দেখা গেল, এক নারী ৫ লিটারের দুই বোতল সয়াবিন তেল নিয়ে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, প্রতি বোতল ৭৬০ টাকা করে কিনেছেন। বললেন, ‘পাইছি যে এটাই কপাল!’