সবাই যখন বড় বড় ক্রয়াদেশের পেছনে ছুটেছেন, তখন ছোট ছোট ক্রয়াদেশের কাজ করতেন উদ্যোক্তা শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ। তাতেই সফল তিনি। তাঁকে নিয়েই এবারের মূল আয়োজন।
দামে সস্তা, পরিমাণে বেশি—এই নীতিতে বাংলাদেশে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছে। তাতে রপ্তানিতে দ্রুত শীর্ষ দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। উদ্যোক্তারাও এই নীতিতেই অভ্যস্ত। তবে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেও একজন সফল হয়েছেন, তিনি শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ।
পোশাক খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ পিস পোশাকের কম কোনো ক্রয়াদেশের কাজ তো করেনই না, এ নিয়ে কথাই বলতে চান না। সেখানে কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ হাসিমুখে ১০০ পিসেরও ক্রয়াদেশ নেন। ছোট ক্রয়াদেশ ব্যবস্থাপনার মতো চ্যালেঞ্জিং জায়গাতেই নিজের প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। শুধু তা–ই নয়, ক্রেতাদের নিত্যনতুন নকশার কাপড় দিতে এই উদ্যোক্তা নিজেই গবেষণা করেন। ফলে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায়ও তাঁর জন্য সহজ হয়ে গেছে।
১৪ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে ছোট্ট একটা কারখানা দিয়ে উদ্যোক্তা মোস্তাফিজের যাত্রা শুরু। সেখান থেকে পাঁচ বছর আগে ধামরাইয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তোলেন। ধামরাইয়ের কারখানার ৩০০ কর্মী প্রথম বছর ৩৫ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেন। গত বছর কর্মীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পাঁচ শতাধিক। আর রপ্তানি ৪৫ লাখ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার কাছাকাছি। বর্তমানে কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রিজ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, নরওয়ে, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৪০টি ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে। ছোট ক্রয়াদেশের কাজ করলেও গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ১৫ লাখ ৮১ হাজার ২৪১ পিস পোশাক রপ্তানি করেছে।
মিরপুরের রূপনগরের আরিফাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে শেখ এইচ এম মোস্তাফিজের কার্যালয়। আর ওপরের তলায় বাসা। গত সোমবার নিজ কার্যালয়ে বসে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনান মোস্তাফিজ। জানালেন, কারখানা আর বেশি বড় করার পরিকল্পনা নেই তাঁর। তবে দশকের পর দশক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পরিবেশসম্মত ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি মূল্যের পোশাক তৈরির দিকে নজর দিয়েছেন। সে জন্য আগামী বছরের মধ্যে কারখানার অটোমেশন শেষ হবে। ২০৩০ সালে শুধু টেকসই প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করবে কিউট ড্রেস।
শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ বললেন, ‘উৎপাদন খরচের পর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা না পেলে কোনো ক্রয়াদেশ নিই না। কারখানার বর্তমান সেটআপ দিয়েই আমরা বছরে উচ্চমূল্যের ২ কোটি ডলারের (প্রায় ১৭০ কোটি টাকা) পোশাক রপ্তানি করতে চাই। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ১০০-তে উন্নীত করতে চাই। এতে ব্যবসায় ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি নানামুখী সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
ঢাকার মিরপুরে মোস্তাফিজের জন্ম। তেজগাঁও কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শেষ করে সেখানেই ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। স্নাতক পাস করার পর ১৯৯৯ সালে পণ্যের মান পরীক্ষাকারী সংস্থা এসজিএসে যোগ দেন। চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর করেন।
এসজিএসে কাজ করার সময় কাপড় ও পোশাক সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক কিছু শেখেন মোস্তাফিজ। তিন বছর এসজিএসে কাজ করার পর একটি বায়িং হাউসে যোগ দেন তিনি। সেখানেই প্রথম দেখলেন, পরিমাণের দিক থেকে কম এমন কোনো ক্রয়াদেশ পোশাক কারখানাগুলো নিতে চায় না। তাই ছোট কাজের মধ্যে বড় সম্ভাবনা দেখলেন মোস্তাফিজ।
পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালে নিজেই একটি বায়িং হাউস চালু করলেন। ছোট ছোট অর্থাৎ ১৫০, ২০০, ৫০০ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার পিস পোশাকের ক্রয়াদেশ নিতে শুরু করলেন। তবে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করাতে গিয়ে দেখলেন নানাবিধ সমস্যা। সময়মতো পোশাক বানিয়ে রপ্তানি করাই কঠিন। অনেকে বললেন, এভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু হাল ছাড়লেন না মোস্তাফিজ। ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জের বিসিকে দুই হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্লোরে ৪০-৫০টি মেশিন আর ৬০ জন কর্মী নিয়ে কারখানা শুরু করলেন।
২০১২ সালে এসে বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন মোস্তাফিজ। ডেনমার্কের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। সাংঘাতিক সমস্যায় পড়লেন; কারণ, মোস্তাফিজ যত কাজ করতেন, সেগুলোর ৩০-৩৫ শতাংশই দিত সেই প্রতিষ্ঠান। এরপর মোস্তাফিজ সিদ্ধান্ত নেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ক্রেতার সংখ্যা ৪০।
শুরু থেকেই শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ ছোট ছোট ক্রয়াদেশের কাজ করছেন। তবে ক্রয়াদেশের পরিমাণ যত কম, ব্যবস্থাপনা তত কঠিন। সেই কঠিন কাজকে আয়ত্তে আনলেন। মোস্তাফিজ বলেন, ছোট ক্রয়াদেশের কাজ করার প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাঁচামাল ও সরঞ্জামের সরবরাহ এবং উৎপাদনশীলতা ঠিক রাখা। সে জন্য সাধারণ কারখানায় যেখানে ৫-১০ শতাংশ কর্মচারী থাকেন, সেখানে আমাদের ৩৩ শতাংশই কর্মচারী। বাকিরা শ্রমিক। কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানার সুইং সেকশনে মোট লাইনের সংখ্যা ১৪। বর্তমানে উৎপাদন চলে ৯টিতে। প্রতিটি লাইনে ৪, ৮ কিংবা ১৬টি মেশিন রয়েছে। মোস্তাফিজ বললেন, অন্যান্য নিট কারখানা যেখানে দুই থেকে আড়াই ডলারের পোশাক তৈরি করে, আমরা সেখানে করি সাড়ে চার ডলারের ওপরে।’
অবশ্য কেবল ছোট ছোট ক্রয়াদেশই নয়, নিত্যনতুন নকশার কাপড় উৎপাদনে অনেক সময় ব্যয় করেন মোস্তাফিজ। তাতে প্রচুর কাপড় নষ্ট হয়। অনেক সময় কোনো ক্রয়াদেশও মেলে না। যদিও মোস্তাফিজের উদ্ভাবিত নতুন নকশার কাপড় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। মোস্তাফিজ বললেন, ‘শতভাগ সুতির একটি টি-শার্ট ২-৩ ডলারের বেশি পাওয়া যায় না। তবে উলের টি–শার্ট করে আমরা ১২-১৩ ডলারে রপ্তানি করেছি। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে পোশাকের গড় মূল্য ১০-১২ ডলারে নিয়ে যাওয়া।’
মোস্তাফিজ তাঁর কারখানাকে ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ পরিবেশবান্ধব টেকসই পণ্য উৎপাদনের মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চান। নানামুখী উদ্যোগের কারণে প্রতি পিস পোশাকের উৎপাদনে গত ২০১৯ সালে ১১ লিটার পানি ব্যবহৃত হলেও গত বছর সেটি ৬ লিটারে নেমে এসেছে। বিদ্যুতের ব্যবহার ৭৮ ওয়াট থেকে কমে ৭১ ওয়াট হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ ১২০ গ্রাম থেকে কমে ১০৫ গ্রামে এসেছে।
সহধর্মিণী সামিনা খান আর দুই ছেলে মাসনুন মোস্তাফিজ ও মানাফ মোস্তাফিজকে নিয়ে শেখ এইচ এম মোস্তাফিজের সংসার। সঙ্গে মা–বাবাও আছেন। সময় পেলেই পরিবার নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। মোস্তাফিজ ছোটবেলায় যে বাড়িতে বড় হয়েছেন, ব্যবসা করে সেটি কিনে নিয়েছেন। পাশের একটি বাড়িও কিনে নিয়েছেন। স্রোতের বিপরীতে হেঁটে ব্যবসায়ও সফল। ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন। সেই কর্মীরা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ, হেপাটাইটিস ও যক্ষ্মা পরীক্ষা এবং নারী কর্মীরা কর্মকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিন পান। গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কারখানাটির স্বাস্থ্যবিমা চুক্তি করেছে। ফলে কর্মীরা ৩০০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পান। দূরের শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থাও রয়েছে।
অর্জনগুলো কতটা তৃপ্তি দেয় জানতে চাইলে মোস্তাফিজ বলেন, ‘আমাকে তৃপ্তি দেয়। সমুদ্রে সবাই যেখানে নামে, সেখানকার পানি ঘোলা থাকে। আর যেখানে কেউ নামে না, সেখানে নীল পানি। আমি নীল পানিতেই সাঁতার কাটি মনের আনন্দে। এটাকে বলা হয় নীল জল কৌশল।’
তরুণদের উদ্দেশে কী পরামর্শ জানতে চাইলে মোস্তাফিজ বলেন, ‘পোশাকশিল্পের ব্যবসায় তরুণদের আসার সুযোগ আছে। তবে অনেক জানতে হবে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে, আমি একজন দরজি। গাড়ি, বাড়ি আর টাকার পেছনে ছুটলে কখনোই সেগুলো ধরা দেবে না। কাজের পেছনে ঠিকঠাক দৌড়াতে পারলেই অর্থবিত্ত আপনার পেছনে দৌড়াবে। আমি কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।’
প্রতি শনিবার নিয়ম করে কারখানায় যান মোস্তাফিজ। বাকি দিন বাসার নিচের অফিসে কাজ করেন। নতুন নকশার কাপড় উদ্ভাবন, ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিপণনে (মার্কেটিং) সময় কাটান। দুপুরের খাবার খেয়ে এক ঘণ্টা ভাতঘুমও দেন। তারপর আবার কাজে নামেন। হঠাৎ কী খেয়ালে জানতে চাইলাম, ভাই, ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক জীবন নিয়ে আপনি কি সুখী মানুষ? একবাক্যে উত্তর দিলেন—হ্যাঁ, আমি সুখী মানুষ। তাঁর উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধরনের কাপড় দেখার পর যখন ফিরছিলাম, তখন মনটা বেশ ফুরফুরে। সুখী মানুষের দেখা পাওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!