অসহনীয় একটা সময় পার করছি আমরা। তবে মহামারির এই হতাশার মধ্যেও যে কটি পরিবর্তন আশার আলো দেখাচ্ছে, তার মধ্যে ‘স্টার্টআপ’ নিঃসন্দেহে অন্যতম। কঠোর লকডাউন, কোমল লকডাউন, সাধারণ ছুটি, ব্যবসায় স্থবিরতা—এত সব হতাশার মধ্যেও যে কটি খাত অব্যাহতভাবে চলমান ছিল, তা হচ্ছে ডিজিটাল লেনদেন (ফিনটেক), ই-কমার্স এবং প্রযুক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা (ডিজিটাল হেলথ) উদ্যোগগুলো।
ফেসবুকভিত্তিক লাখখানেক অনলাইন ব্যবসার কাপড়চোপড় হোক কিংবা গয়না, হোক, মোবাইল কিংবা ইলেকট্রনিকস অথবা রেস্তোরাঁর খাদ্য, টেলিমেডিসিন হোক কিংবা মেডিসিন ডেলিভারি—সবকিছুতেই গতিশীল ছিল এই ই-কমার্স এবং অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ডিজিটাল হেলথের উদ্যোগগুলো।
সাফল্যের এই অংশে বাড়তি হাওয়া দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু স্টার্টআপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ। প্রথমে আসে শপআপের বিনিয়োগ সাফল্যের কথা। গত বছরের শেষের দিকে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা এই স্টার্টআপ ‘রাউন্ডে’ বিনিয়োগ পেয়েছে ২২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার, দেশের স্টার্টআপ জগতে যা সর্বোচ্চ (বিকাশের বিনিয়োগ বাদ দিয়ে)। ভারতের সিকোয়া ক্যাপিটাল, ফ্লারিশ ভেঞ্চার, ভিওন ভেঞ্চার ও স্পিডইনভেস্ট এবং সিঙ্গাপুরের লনসডেল ক্যাপিটাল সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ করেছে শপআপে। সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি বড় বিনিয়োগ এসেছে পণ্য সরবরাহকারী স্টার্টআপ পেপারফ্লাইয়ে, ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া স্টার্টআপটিতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ভারতের প্রযুক্তি খাতের অন্যতম বৃহৎ পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইকম এক্সপ্রেস, যা কিনা ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ারবার্গ পিনকাস এবং সিডিসি গ্রুপের আওতাধীন পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
উল্লেখ করা যায়, দেশীয় হেলথ-টেক স্টার্টআপ প্রাভা হেলথ এবং মায়ার কথা। বিভিন্ন এঞ্জেল ইনভেস্টরের কাছ থেকে প্রাভা বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে মায়াতে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে দেশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম অ্যাঙ্করলেস বাংলাদেশ এবং বাইরের ওসিরিস গ্রুপ।
সরকারি বিনিয়োগও এখন আসছে স্টার্টআপ খাতে। ২০১৯ সালে সরকারি অনুমোদন পাওয়া সরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান স্টার্টআপ বাংলাদেশ সম্প্রতি প্রথমবারের মতো বিনিয়োগ করেছে সাতটি দেশীয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে পাঠাও লিমিটেড, সেবা এক্সওয়াইজেড, চালডাল ডটকম, ইনটেলিজেন্স মেশিন, ঢাকা কাস্ট, এডু হাইভ এবং মনের বন্ধু বিনিয়োগ পেয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
গল্পের এই অংশ যেমন আশাপ্রদ, এর বিপরীত চিত্রটাও কিছুটা হতাশাজনক। এই পুরো বিনিয়োগ কার্যক্রমে নেই দেশি বিনিয়োগকারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। দেশি এঞ্জেল ইনভেস্টর, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কিংবা ইকুইটি ফার্মের এখনো বড় কোনো বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না দেশীয় এই স্টার্টআপগুলোয়। সম্প্রতি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসেল পার্টনার্স তাদের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ২০১০ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্টার্টআপে ১৬৫টি ‘ইনভেস্টমেন্ট ডিল’ হয়েছে, যার মোট বিনিয়োগ মূল্য ৩৩০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে এসেছে মাত্র ২১ মিলিয়ন ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৬ শতাংশেরও কম।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, বিদেশি বিনিয়োগকারী ফার্মগুলো যেখানে দেশি স্টার্টআপগুলোয় সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে এবং বিনিয়োগ করছে, সেখানে দেশীয় বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো কেন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে আসছে না। নিদেনপক্ষে এঞ্জেল ইনভেস্টররা কেন বিনিয়োগ করছে না? এ ক্ষেত্রে আমরা যদি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে দেখি, সেখানে স্টার্টআপ ইকো সিস্টেমের বড় একটা অংশ গড়ে উঠছে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে, তারা শক্ত ভূমিকা রেখেছে নিজের দেশকে বিশ্বের স্টার্টআপ মানচিত্রে চার নম্বর স্থানে নিয়ে যেতে।
২০২০ সালে, করোনা ক্রাইসিসের মধ্যেও দেশটির স্টার্টআপগুলোয় ‘ডিল’ হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০–এর মতো, যেখানে বিনিয়োগ এসেছে মোট ১০ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার (হেক্সজেন কন্সাল্টিং ফার্মের তথ্য মতে), যা ২০১৯ সালের চেয়ে কম হলেও (২০১৯ সালে বিনিয়োগ হয়েছে ১৪.৫ বিলিয়ন ডলার) ২০ শতাংশ বেশি।
বিপরীতে আমাদের চিত্রটা একটু হতাশাজনকই বটে। সম্প্রতি শুধু দুটি স্টার্টআপে দেখা গিয়েছে স্থানীয় এঞ্জেল ইনভেস্টর কিংবা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের (ভিসি) অংশগ্রহণ। একটি হচ্ছে আগে উল্লেখিত মায়া, যাতে বিনিয়োগ করেছে দেশীয় ভিসি ফার্ম অ্যাঙ্করলেস বাংলাদেশ। আর আরেকটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস, যাতে ৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে আরেক ভিসি ফার্ম—আইডিএলসি ভিসি ফান্ড-১। এর বাইরে হাতে গোনা আরও কয়েকটি ভিসি ফার্ম আছে দেশে, উল্লেখযোগ্য নাম হলো বিডি ভেঞ্চার্স, বাংলাদেশ এঞ্জেলস নেটওয়ার্ক, সীমিত আকারে যারা বিনিয়োগ করে যাচ্ছে দেশীয় স্টার্টআপগুলোয়।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, দেশীয় কনগ্লোমেরেটদের কেন এত অনাগ্রহ এই ভেঞ্চার ক্যাপিটালের প্রতি, স্টার্টআপগুলোয় বিনিয়োগের প্রতি? একটা সহজ উত্তর হচ্ছে, ভিসিদের, বিশেষত করপোরেট ভিসিদের, বিনিয়োগের বড় একটা আকর্ষণ হচ্ছে ‘গ্রোথ’ পর্যায়ে থাকা স্টার্টআপগুলো; আর বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোর মধ্যে খুব কমসংখ্যক আছে, যারা এ পর্যায়ে গিয়েছে। ফলে, করপোরেট ভিসিদের আগ্রহও স্বাভাবিকভাবে কম ‘সিড’ কিংবা ‘প্রাথমিক’ পর্যায়ে থাকা স্টার্টআপগুলোয় বিনিয়োগ করা।
প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু কি আর্থিক রিটার্নের আশায় ভিসিরা বিনিয়োগ করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাক, আমেরিকার ব্যবসা শিক্ষার বিখ্যাত তাত্ত্বিক অধ্যাপক হেনরি চেসব্রোর বিখ্যাত ম্যাট্রিকস—কোন জিনিসটি করপোরেট ভিসিদের স্টার্টআপে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি তাড়িত করে? চেসব্রোর এই ম্যাট্রিকস থেকে দেখা যায়, করপোরেট ভিসিদের চারটি উদ্দেশ্যর মধ্যে তিনটি হচ্ছে কৌশলগত—‘এমারজেন্ট’ (নতুন ব্যবসা খুঁজে দেখতে চাওয়া), ড্রাইভিং (বর্তমান ব্যবসার স্ট্র্যাটেজিকে আরও বেগবান করা) এবং ‘এনাব্লিং’ (বর্তমান ব্যবসার সঙ্গে পরিপূরক হয়, এমন জায়গায় বিনিয়োগ করা)। এ তিন কৌশলগত লক্ষ্য ছাড়া একটিমাত্র লক্ষ্য হলো ‘প্যাসিভ’, অর্থাৎ শুধু ফাইন্যান্সিয়াল রিটার্ন।
এখন এ উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে যদি আমরা দেশীয় কনগ্লোমেরেটদের সঙ্গে মেলাই, সাধারণত অতি ঝুঁকির ব্যবসার দিকে কিংবা কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে বিনিয়োগ করা আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে কম। যেহেতু দেশের স্টার্টআপগুলোর বড় একটা অংশই এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, সে ক্ষেত্রে দেশি এঞ্জেল ইনভেস্টরদের অংশগ্রহণ আরেকটু বেশি আশা করাই যায়, সেটা হতে পারে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ভিসি হয়ে।
এ ক্ষেত্রে বলা যায়, বড় একটা সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন ভাসছে অতিমাত্রায় তারল্যে। অলস পড়ে থাকা এই অর্থের কিছু অংশ যদি আসে স্টার্টআপ খাতে, পাল্টে যেতে পারে স্টার্টআপ জগতের চেহারা। নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকা এই অর্থের মাত্র ১ শতাংশ, যা অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা, যদি বিনিয়োগ হয় বর্তমানে সক্রিয় প্রায় ১ হাজার স্টার্টআপে, অভাবনীয় একটা পরিবর্তন আসতে পারে দেশের অর্থনীতিতে।
আশার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন ৫০০ কোটি টাকার স্টার্টআপ তহবিল গঠন করেছে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের ঋণের জন্য, একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য নীতি প্রণয়ন করেছে, যাতে ব্যাংকগুলো চাইলে তাদের বার্ষিক নিট মুনাফার ১ শতাংশ দিয়ে স্টার্টআপ তহবিল গঠন করতে পারবে।
তবে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে ব্যক্তিগত কিংবা বেসরকারি জায়গা থেকেও দায়িত্ব পালনের সময় বোধ হয় চলে এসেছে ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের। অর্থকে অলস ফেলে না রেখে কিংবা বাইরে না পাঠিয়ে দেশীয় স্টার্টআপগুলোয় বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ এখন সামনে!
প্রশ্ন হচ্ছে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে সামনে এগিয়ে আসবে কারা?