স্বর্ণ বা সোনার চরিত্র অদ্ভুত। সুখের দিনে সোনার দাম থাকে কম, কষ্টের দিনে দর বাড়তেই থাকে। এই যেমন করোনার প্রাদুর্ভাবে অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, মন্দায় বেশির ভাগ দেশ, আয় কমে গেছে সাধারণ মানুষের, ঠিক তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। জ্বালানি তেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেখানে অনেক কম, সেখানে সোনার মতো বিলাসী পণ্যের দাম কেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে?
কেবল যে এখন বাড়ছে তা নয়, গোল্ডম্যান সাকস বলছে, আগামী বছর আরও বাড়বে। তাদের প্রাক্কলন বলছে, ২০২১ সালে সোনার দর বাড়বে ২২ শতাংশ। আর তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে এক আউন্স সোনার দর বেড়ে হবে ২ হাজার ৩০০ ডলার। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এক আউন্স সোনার দর ১ হাজার ৯০০ ডলারের কাছাকাছি। মাঝে অবশ্য ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই দর ২ হাজার ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। ২৮ দশমিক ৩৫ গ্রামে এক আউন্স আর ১১ দশমিক ৬৬ গ্রামে হয় এক ভরি। গোল্ডম্যান সাকস মনে করে, আগামী বছরও অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। ফলে সোনার দরও বাড়ব। এ বছর এখন পর্যন্ত সোনার দর বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অনিশ্চয়তায় কেন সোনার দাম বাড়ে?
হলিউডের সিনেমা ম্যাকানাস গোল্ড মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৯ সালে। লুকিয়ে রাখা সোনার সন্ধান আছে একটা ম্যাপে। সেই ম্যাপ একবার দেখেই পুড়িয়ে ফেলেছিলেন গ্রেগরি পেক। পুরো ম্যাপ বা নকশাটা ছিল গ্রেগরি পেকের মাথায়। সেই সোনার সন্ধানে প্রথমে হাজির হন ম্যাক্সিকান আউট ল ওমর শরীফ। তারপর একে একে অন্যরা। পুরো সিনেমাটাই স্বর্ণের সন্ধানে এক রুদ্ধশ্বাস অভিযানের গল্প। সঙ্গে ছিল নানা অনিশ্চয়তা, খুন, অবিশ্বাস, দুর্ঘটনা। সোনা ভবিষ্যৎ জীবনে নিশ্চয়তা আনবে, নিরাপত্তা দেবে, এই আশায় জীবন বাজি রেখে সোনার সন্ধানে যাওয়া। এখন যেমন, সামনের অনিশ্চিত সময়ে নিশ্চয়তা দেবে, এই আশায় সোনা কিনে যাওয়া। আর এ কারণেই বাড়ছে সোনার দাম। সব সময়ই সোনা হচ্ছে নিরাপদ সঞ্চয়। এর কোনো ক্ষয় নেই। সোনা এমনই এক পণ্য, যার সংরক্ষণমূল্য অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও বাড়ছে সোনার দর। তবে এখানে গয়না ছাড়া সোনার চাহিদা নেই বললেই চলে। আরও অনেক দেশের মতো বিনিয়োগের উপাদান হিসেবে সোনার কোনো ভূমিকা নেই। তবে চোরাচালানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সোনার রুট হোসেনের বেশি ব্যবহার হয়। দেশে এখন ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার অলংকার কিনতে লাগবে ৭৬ হাজার ৩৪১ টাকা। শীতের এই বিয়ের মৌসুমের জন্য দুঃসংবাদই বটে।
যেকোনো পণ্যের দামের ওঠানামা নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপরে। তবে সোনার ক্ষেত্রে যোগ হয় ভোক্তার আচরণ। কেউ যদি মনে করেন সামনে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, তাহলে কিন্তু অর্থের ওপর ভরসা কমে যায়। কারণ, মূল্যস্ফীতি বাড়লে অর্থের মূল্যমান হ্রাস পায়। তখন মনে করা হয়, এমন কিছু পণ্য কিনে রাখতে হবে, যার ক্ষয় নেই। এমন নয় যে বছর বছর সোনার খনি থেকে সোনার সরবরাহ আসতেই থাকে। সুতরাং, এখানে চাহিদা-জোগানের সম্পর্কের তুলনায় ভোক্তার আচরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, এ সময় এখন পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আবার এখন বিশ্বব্যাপী সুদহার কম। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট হয়ে আসছেন জো বাইডেন। ধরে নেওয়া হচ্ছে, তিনি প্রণোদনা আরও বাড়াবেন। এতে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বলছে, তারা মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে ধরে রাখার যে লক্ষ্য, সেখান থেকে কিছুটা সরে যেতে পারে। এসব কারণেই নগদ অর্থ, শেয়ারবাজার, বন্ড বা অন্য কোনো বিনিয়োগের তুলনায় সোনা কিনে রাখাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
১৯৭০–এর সংকটের সময় সোনার দর আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার বেড়ে ৫২৫ ডলার হয়েছিল। ১৯৮০–তে সেই দর হয় ৬১৫ ডলার। কিন্তু ১৯৯০ সালে সেটি অনেক কমে হয়েছিল ৩৮৩ ডলার। কিন্তু ২০০৮ সালে আবার অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে ২০১১ সালে সোনার দর অনেক বেড়ে ১ হাজার ৯০০ ডলার হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের অর্থনীতিবিদ ক্লড বি আরব ও ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ক্যাম্বেল হার্ভের ‘গোল্ডেন ডিলেমা’ নামের এক গবেষণা দেখাচ্ছেন যে আসলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সোনার দরের সম্পর্ক খুব বেশি না। সম্পর্কটা আসলে ভয় বা আতঙ্কের। সেই ১৯৩০–এর মহামন্দার সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে, সংকট এলেই সোনার দর বাড়তে থাকে।
১৯৭০–এর সংকটের সময় সোনার দর আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার বেড়ে ৫২৫ ডলার হয়েছিল। ১৯৮০–তে সেই দর হয় ৬১৫ ডলার। কিন্তু ১৯৯০ সালে সেটি অনেক কমে হয়েছিল ৩৮৩ ডলার। কিন্তু ২০০৮ সালে আবার অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে ২০১১ সালে সোনার দর অনেক বেড়ে ১ হাজার ৯০০ ডলার হয়েছিল। মাঝে অবশ্য ২০১৫ সালের দিকে ১ হাজার ৪৯ ডলারে নেমে এলেও তা বেশি দিন থাকেনি। দুই অর্থনীতিবিদ আরব ও হার্ভে মনে করেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা–ই হোক, একবার যদি বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তাহলে দাম যা–ই হোক, তাঁরা কিনতেই থাকেন। এখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় বা আতঙ্কটাই মূল বিষয়।
চীন ও ভারতে সোনার বড় ব্যবহার গয়নায়। কিন্তু একটা সময় ছিল, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সোনার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেই স্বর্ণযুগের অবসান ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের এক ঘোষণায়। তিনি ‘স্বর্ণ মান’ বা গোল্ড স্টান্ডার্ডের অবসান ঘটিয়েছিলেন। এর আগপর্যন্ত একটি দেশের কি পরিমাণ সোনা সংরক্ষণে আছে, তার ওপর ভিত্তি করে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ ঠিক করতে হতো। নিক্সন মনে করেছিলেন, এর ফলে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে, ঠিকমতো মুদ্রানীতি নেওয়া যাচ্ছে না। ওই ঘোষণার পর থেকে মুদ্রা ব্যবস্থায় স্বর্ণের স্বর্ণ যুগের অবসান ঘটলেও সংকটের সময় ঠিকই সোনার গুরুত্ব বেড়ে যায়।
স্বর্ণমান উঠে গেলেও বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো স্বর্ণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ সংরক্ষণ করে। দাম বেশি পেলে তারা বিক্রিও করে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি বেড়ে গেলে। তবে ১৯৯৯ সালে করা ওয়াশিংটন চুক্তি অনুযায়ী, বছরে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪০০ মেট্রিক টনের বেশি স্বর্ণ বিক্রি করতে পারবে না।
সোনার দাম বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু চাহিদাও ক্রমে কমছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল বলছে, আগের বছরের তুলনায় এখন সোনার চাহিদা কমেছে ১০ শতাংশ। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে গয়নার চাহিদা। আগের বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় গয়নার চাহিদা কমেছে ২৯ শতাংশ। বলে রাখা ভালো, বিশ্বে সোনার যত ব্যবহার, তার অর্ধেকই হয় দুই দেশে, চীন ও ভারত। বলাই বাহুল্য, তা গয়না হিসেবে।
অন্যদিকে বেড়েছে সোনার মুদ্রা ও বারের চাহিদা। চাহিদা বৃদ্ধির হারও অনেক বেশি, ৪৯ শতাংশ। মূলত পশ্চিমা দেশগুলো ও তুরস্কেই নিরাপদ বিনিয়োগের উপাদান (এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডস-ইটিএফ) হিসাবে স্বর্ণমুদ্রা ও স্বর্ণবারের ব্যবহার বেশি বাড়ছে। এর বাইরে সোনার ব্যবহার আছে দুইভাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কেনাবেচা করে এবং শিল্প খাতের নানা পণ্য উৎপাদনে স্বর্ণের প্রয়োজন পড়ে। করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামান্য কিছু সোনা বিক্রি করেছে আর শিল্প খাতে চাহিদা কমেছে ৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে সোনার চাহিদা ১০ শতাংশ কমলেও সরবরাহ কমেছে ৩ শতাংশ।
বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনা খুব ভালো এটা কেউ বলছে না। যে দামে সোনা কেনা হয়, সেই দামে বিক্রিও করা যায় না। তারপরেও বিপদের জন্য মানুষ সোনার ওপরেই ভরসা রাখে। সুতরাং চাহিদা বা জোগান যা–ই থাকুক, অনিশ্চয়তার সময় সোনার দাম বাড়বে, এটা এখন ঐতিহাসিক সত্য।