রোজা শুরুর আগেই বিক্রিবাট্টা প্রায় শেষ। এখনো নতুন করে প্রতিদিন পোশাকের চাহিদা আসছে।
কেরানীগঞ্জ পোশাকপল্লিতে ঢোকার আগেই বোঝা গেল এবার ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। পল্লির ভেতরের এলাকা যানবাহনে ঠাসা। তাই শনিবার ছুটির দিনেও রিকশায় চড়ে খুব বেশি দূর যাওয়া গেল না। আগানগর ছোট মসজিদ এলাকা থেকে হাঁটা শুরু করতে হলো। এরপর কর্মচঞ্চল পোশাকপল্লি ঘুরে দেখার পালা। পাশাপাশি খোঁজ নিতে থাকলাম কেমন চলছে এবারের ঈদের পাইকারি ব্যবসা। কারণ, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে প্রায় দুই বছর পর এবারই অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে ঈদকেন্দ্রিক কেনাবেচা চলছে।
কথা হয় সেখানকার আলম টাওয়ারের নিচতলার পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী মুনির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করোনার নতুন কোনো ঢেউ আসবে কি আসবে না, এই চিন্তায় এবার খুব বেশি পণ্য তৈরি করিনি। ২০ হাজার পাঞ্জাবি বানিয়েছিলাম, যার পুরোটাই বিক্রি হয়ে গেছে রোজা শুরুর আগেই। এখন নতুন চাহিদা আসছে। কিন্তু সরবরাহের সক্ষমতা নেই। তাই বেছে বেছে কিছু কাজ করছি।’ ব্যবসার এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২–৩ বছরের মধ্যে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে জানান মুনির হোসেন।
গত শনিবার দিনভর পোশাকপল্লি ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে মুনির হোসেনের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। গত দুই বছর করোনার কারণে এই পল্লির ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবার হারানো ব্যবসার আগের অবস্থা ফিরে পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এবার আরও ভালো ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় অনেক ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিতে চাননি। এ ছাড়া মূলধনসংকট, কাপড় ও সুতার বাড়তি দামের কারণেও ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি ব্যাহত হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাকের ৮০ শতাংশ বাজার এই পল্লির দখলে। কেরানীগঞ্জের এই পোশাকপল্লির ব্যাপ্তি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, আগানগর ছোট মসজিদ, পূর্ব আগানগর গুদারাঘাট, চরকালীগঞ্জ ও খেজুরবাগান এলাকা মিলিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে। সেখানে গড়ে উঠেছে তিন শতাধিক শপিং মল। ছোট ও মাঝারি আকারের পোশাককারখানাসহ যেখানে জায়গা নিয়েছে প্রায় ১০ হাজারের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মালিক সমিতির নিবন্ধিত সদস্য ৬ হাজার।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুসলিম ঢালি বলেন, ‘এবার ব্যবসা ভালো হয়েছে। তবে আরও ভালো হতে পারত। সুতার দাম বাড়তি। এতে পণ্যের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে চাহিদামাফিক ঋণও পায়নি। এখানে ৩০-৩২টি ব্যাংকের শাখা আছে। যার মধ্যে ৫-৭টা ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। বাকিরা আমানত সংগ্রহে ব্যস্ত। ঋণ বিতরণে আগ্রহ তাদের আগ্রহ নেই।’
কেরানীগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতিটি জিনস প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। তবে কিছু দোকানে হাজার টাকার মধ্যেও ভালো মানের জিনস বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পাঞ্জাবি ২৫০-৬০০ টাকা, শার্ট ১৫০-৫০০ টাকা, টি–শার্ট ৬০- ২০০ টাকা, মেয়েদের থ্রিপিস ২৫০-৫০০ টাকা ও লেহেঙ্গা ৪৫০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শহীদুল আলম সুপার মার্কেটের নিচতলার সিয়াম গার্মেন্টসে পাওয়া গেল বেশ কয়েকজন পাইকারি ক্রেতা। শরীয়তপুর থেকে আসা আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘কম মূল্যে ভালো মানের পোশাক পাওয়া যায় বলে এখানে আসি। একসময় ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে আসতাম। ট্রাকে করে পণ্য নিয়ে ফিরতাম। এখন সবাই সবার মতো আসে। পণ্য যায় কুরিয়ারে।’
পুরোনো ব্যবসায়ীদের দাবি, স্বাধীনতার পর এই এলাকায় এ ব্যবসার শুরু। তবে এ বাজারের ব্যাপ্তি বেড়েছে গত তিন দশকে। এখানকার ব্যবসায়ীদের বড় অংশই মুন্সিগঞ্জের। তবে এই বাজারে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ভোলাসহ প্রায় সব জেলার ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন।
এখানের পোশাকের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সহযোগী আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই পল্লি কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে ৩০টির বেশি পণ্য সরবরাহকারী কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান। আছে বোতাম, চেইন, লেইস-ফিতা, সুতার দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানও এবার ভালো ব্যবসা করেছে। রাত্রি বোতামঘরের স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা রোজার আগেই শেষ। পোশাকের ব্যবসা ভালো হওয়ায় আমাদের ব্যবসাও ভালো।’
পোশাক ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এই পল্লিতে কর্মসংস্থান হয়েছে তিন লক্ষাধিক লোকের। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তা ১০ শতাংশ। পোশাককারখানার শ্রমিকদের ২৫-৩০ শতাংশই নারী। তবে গত দুই বছর করোনার কারণে নতুন কোনো উদ্যোক্তা তৈরি হয়নি। বরং অনেকে ব্যবসা ছেড়েছেন।
এখানকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা মূলত দুই ঈদ কেন্দ্র করে। বেচাকেনা শুরু হয় শবে বরাত থেকে। বেচাকেনা চলে মাহে রমজানের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর মধ্যে রোজার ঈদেই ব্যবসা বেশি হয়। আর এই ব্যবসা ধরতে কোরবানির ঈদের পর থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।
এবার ব্যবসা ভালো হওয়ায় এখনো সরগরম পোশাক কারখানাগুলো। খাজা সুপার মার্কেটের পঞ্চম তলার সিদ্দিক গার্মেন্টসে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকদের দম ফেলার ফুরসত নেই। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘করোনার সময় শ্রমিকসংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলাম। এবারের ঈদে দুই লক্ষাধিক পণ্য তৈরি করেছি। বেশির ভাগ পণ্য বিক্রি হয়ে গেছে। এখনো নতুন করে ক্রয়াদেশ আসছে।’
সিদ্দিক গার্মেন্টসের পার্শ্ববর্তী সাদী গার্মেন্টসের কারিগর ফেরদৌস হোসাইন বলেন, ‘তিন বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। এবারই সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে। তাতে বাড়তি কিছু পয়সা নিয়ে এবার ঈদে বাড়ি ফিরতে পারব বলে আশা করছি।’
গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও কেরানীগঞ্জ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি স্বাধীন শেখ প্রথম আলোকে জানান, ‘সারা বছরের ব্যবসার তিন-চতুর্থাংশই হয় ঈদুল ফিতরে। ইতিমধ্যে এখানকার ৮০ শতাংশের বেশি পণ্য বিক্রি হয়ে গেছে। তাতে বলা যায়, হারানো ব্যবসা আবার জেগেছে। তবে প্রস্তুতির শুরুতে করোনা নিয়ে ভয় ছিল। তাই ব্যবসায়ীরা প্রথমে কম পণ্য তৈরি করেছে। তা না হলে আরও ভালো ব্যবসা হতো।’
কেরানীগঞ্জের এই পোশাকপল্লি দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাকের ৮০ শতাংশ সরবরাহ করলেও এখানে পাওয়া যায় না দেশের বহুল পরিধেয় দুই পোশাক শাড়ি ও লুঙ্গি। বাজারজুড়েই আধিপত্য দেখা গেল ডেনিম তথা জিনসের। ডেনিমের প্যান্ট, শার্ট, থ্রি-কোয়ার্টার সবকিছুই সুলভ মূল্যে মেলে এখানে। এ ছাড়া চেক শার্ট, পোলো শার্ট, টি–শার্ট, পাঞ্জাবি, ট্রাউজার, থ্রি–পিস, ওয়ান–পিস, লেহেঙ্গা, ওড়না, বাচ্চাদের পোশাক, বোরকা, আবায়াসহ ছোট-বড় সবার পোশাক পাওয়া যায়।
ভবিষ্যতে এ পল্লিতে শাড়ি ও লুঙ্গির ব্যবসা চালুর পরিকল্পনার কথা জানান স্থানীয় দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুসলিম ঢালি। তিনি বলেন, ‘পোশাকের এই দুটি ধরন আমাদের পল্লিতে নেই। কিন্তু এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। তাই আমরা ভবিষ্যতে এই দুই পোশাকের পাইকারি ব্যবসা শুরু করতে চায়।’