পেশাগত নানা প্রয়োজনে আমি সদ্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে গিয়েছি। সম্পর্কের ক্ষেত্রে উনি আমার কাছে সব সময়ই ছিলেন অভিভাবকতুল্য। তাঁকে তাই চাচা বলেই সম্বোধন করতাম। এটাকে উনি সানন্দে উপভোগ করতেনও। স্নেহ আর পরম মমতায় জড়াতেন। ওনার এই চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। দুঃখভারাক্রান্ত মনে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি।
তাঁর সারা জীবন ও কর্মই আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তবে বিশেষভাবে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। আমি তখন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম একটা অনুষ্ঠানে এলেন। একই অনুষ্ঠানে মুহিত চাচাও আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। তিনি সারাটা দিন ওই অনুষ্ঠানে থাকলেন। আবদুল কালামকে সঙ্গ দিলেন। আমরা দেখলাম তাঁর থেকে মুহিত চাচার জানার আগ্রহের শেষ নেই। সেদিন বুঝলাম জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শ মুহিত চাচা কতটা উপভোগ করতেন। প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের চরিত্র হয়তো এমনই। সব পরিচয় ছাপিয়ে তাই শেষ বয়সে তিনি জ্ঞানের সাধক হয়ে উঠলেন। লিখে গেছেন অনেক কিছু।
মুহিত চাচাকে নিয়ে স্মৃতিচারণের জন্য শব্দভান্ডার শেষ হওয়ার নয়। এর মধ্যে কিছু কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের অর্থনীতির আজকের এই রূপান্তরের পেছনে মুহিত চাচার অবদান অনস্বীকার্য। প্রাজ্ঞ এই অর্থনীতিবিদের মেধা ও শ্রম আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। দেশের বাজেটের আকার বড় করতে উনি যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা এককথায় অভূতপূর্ব। এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তি দিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তাঁর সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বোঝাপড়াও দারুণ ছিল।
একজন অর্থমন্ত্রী হয়ে তিনি ছিলেন ব্যাংক খাতের অভিভাবক ও পরামর্শক। বর্তমানে ব্যাংকে যে সুদহার (নয়-ছয়) বাস্তবায়ন হচ্ছে তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। তিনি ব্যাংক খাতকে আরও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর নেওয়া পদক্ষপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপ্তি বাড়ানো, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণ, গ্রিন এনার্জি ঋণ (সৌরশক্তি সেচ প্রকল্প), কৃষকের জন্য ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব ইত্যাদি।
তবে তিনি ব্যাংক খাতে আরও বড় পরিবর্তন চাইতেন। আমরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি তখন জেনেছি, তিনি চাইতেন বাংলাদেশে আরও শক্তিশালী ও বড় ব্যাংক খাত গড়ে উঠুক। এ জন্য তিনি প্রয়োজনে কয়েকটি ব্যাংকের একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের কথাও বলতেন। আরও কিছুটা সময় পেলে হয়তো এমন সাহসী উদ্যোগ নিতেনও। আজকে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে সরকার যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে, এটার স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন তিনি।
ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাবেক এই অর্থমন্ত্রী ছিলেন নির্মোহ, সরল ও কর্মনিষ্ঠ। সব সময় কাজ নিয়েই থাকতেন। তবে কাজের বাইরে পারিবারিক জীবনেও ছিলেন প্রাণবন্ত। একটা ছোট অথচ শিক্ষণীয় ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই। আমি একবার সিঙ্গাপুরে গেলাম। সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করতে হবে ভেবে কোনোমতে থাকা যায়, এমন একটি হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। সকালের নাশতায় ওই হোটেলে মুহিত চাচার সঙ্গে দেখা। তখন তিনি অর্থমন্ত্রী। এমন হোটেলে তাঁকে পেয়ে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ, একটা দেশের অর্থমন্ত্রী এমন হোটেলে থাকতে পারেন, তা অন্তত আমার ধারণায় ছিল না। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমি এসেছি ব্যক্তিগত কাজে। চিকিৎসা করাব। তোমার সঙ্গে দেখা হবে, গল্প হবে।’ এই মানুষটিই বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী, আমার মুহিত চাচা।
সাবেক চেয়ারম্যান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)।