করোনা শুরু হওয়ার পর দেশে ও বিদেশে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ হতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ছেড়ে দিতে শুরু করে, বড় কার্যালয়ও বন্ধ হতে থাকে। কারও কারও উদ্যোগে পড়ে যতিচিহ্ন। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জোয়ার বয়ে যায় সম্প্রসারণের। এ সময় বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান যেমন আমাজন, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট কিংবা জুম—সব কটিই এই সময়ে কয়েক গুণ বড় হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় হওয়ার ঘটনা কিন্তু কেবল বৈশ্বিক নয়, স্থানীয়ও বটে। এই যেমন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান উইডেভস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই স্নাতকের প্রতিষ্ঠানটি এই সময়ে প্রায় আড়াই গুণ বড় হয়েছে। তাদের কোনো কোনো প্রোডাক্ট হয়ে গেছে বিশ্বের এক নম্বর!
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ই-কমার্স। বিশ্বব্যাপী বেচাকেনার বিরাট অংশ এখন ইন্টারনেটে ঢুকে পড়েছে। বিক্রেতাদের কেউ কেউ নিজেই ফেসবুকে পেজ খুলে বা ওয়েবসাইট বানিয়ে সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। অথবা কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন অনলাইন মার্কেটপ্লেস বা ইন্টারনেটের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। আমাজন, ই-বে, ফ্লিপকার্টের মতো আমাদেরও রয়েছে রকমারি, প্রিয়শপ বা আজকের ডিল। আর এসব ই-কমার্স সাইট বা মার্কেটপ্লেস বানানোর কারিগরি সমাধানে তৎপর তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তারা। বিশ্বের ওয়েবসাইটগুলোর তিন ভাগের এক ভাগ, তথা ৩৪ শতাংশই সহজে ওয়েবসাইট বানানোর সিস্টেম ওয়ার্ডপ্রেসের ওপর নির্ভরশীল। আর এই ওয়ার্ডপ্রেসের সঙ্গে প্লাগইনস নামে সলিউশন জুড়ে দিয়ে ওয়েবসাইটকে বানিয়ে ফেলা যায় নিউজ পোর্টাল (যেমন ওয়াশিংটন পোস্ট) বা মার্কেটপ্লেস (যেমন প্রিয়শপ)।
ওয়ার্ডপ্রেসভিত্তিক বহু বিক্রেতার মার্কেটপ্লেসের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সক্রিয় ও কার্যকরীটির নাম ‘দোকান’। দোকান সলিউশন দিয়ে সহজে আমাজন, ই-বে, শপিফাই, প্রিয়শপের মতো মার্কেটপ্লেস তৈরি করা যায়। আর এটি তৈরি করেছে নিজাম-তারিকের বাংলাদেশি উদ্যোগ উইডেভস। ২০১৯ সালে ‘দোকান’-এ চলত এমন ই-কমার্সের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। এখন এটি বেড়ে হয়েছে ৭০ হাজার! এগুলোর মধ্যে রয়েছে বুটস্ট্র্যাপ, ম্যাশ ডট আইয়ের মতো অনলাইন প্রোডাক্ট বিক্রেতা, মাই মুসলিম মল, ডিজাইন বুমের মতো ই-কমার্স, প্লে দ্য মুভির মতো আর্ট কালচারের মার্কেটপ্লেস, কোরাল কমিউনিটির মতো প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল বিক্রেতাদের দোকান কিংবা ইংল্যান্ডের হউক অ্যান্ড পেডলের মতো মার্কেটপ্লেস। সহজবোধ্যতা, ঝামেলাহীন ব্যবস্থা, সার্বক্ষণিক সাপোর্ট ছাড়াও হউক অ্যান্ড পেডলের সহপ্রতিষ্ঠাতার ভাষায়, ‘মার্কেটপ্লেসকে বড় করার সবই এক জায়গায়’ আছে দেখে দোকান এত জনপ্রিয়।
উইডেভসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বললেন, ‘গত দুই বছরে আমরা “দোকান”কে একটি কমপ্লিট সমাধানে পরিণত করেছি। এখন দোকানে রয়েছে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস অ্যাপ, দেখা যাচ্ছে ব্যবহারকারীদের তথ্য যা অ্যানালিটিকস ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করে ফেলা যাচ্ছে।’
ছোট উদ্যোক্তাদের মার্কেটিংয়েরও সহজ সমাধান দরকার। কাজেই উইডেভস বানিয়ে নিয়েছে ই-মেইল মার্কেটিং সমাধান—উইমেইল। উইমেইল দিয়ে বিশ্বের জনপ্রিয় ই-মেইল সমাধান মেইলচিম্পের চেয়ে ১০ ভাগের ১ ভাগ খরচে ই-মেইল মার্কেটিং করছে প্রায় ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান। এটা দিয়ে যেকোনো উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান তাদের ই-মেইল মার্কেটিংয়ের কাজটা সেরে নিতে পারে।
গত অক্টোবরে এই প্রতিবেদনের জন্য আমি কথা বলি নিজাম উদ্দিন ও তারেক হাসানের সঙ্গে। তাঁরা দুজনই বর্তমানে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে অবস্থান করছেন। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে কিছুদিন আগে তাঁরা সেখানে ঘাঁটি গেড়েছেন। কোম্পানি নিবন্ধন করেছেন।
তারেক হাসান জানালেন, দোকান ছাড়া তাঁদের আরেকটি জনপ্রিয় ওয়ার্ডপ্রেসভিত্তিক ই-সলিউশন হলো ডব্লিউপিইআরপি। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, গ্রাহক ব্যবস্থাপনা, পে-রোল, অ্যাকাউন্টিং, তথা ২২টি মডিউলের একটি ইআরপি সলিউশন আছে, যেটি বিশ্বের ১০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান তাদের নিত্যদিনের কাজে ব্যবহার করছে।
নিজাম উদ্দিন জানালেন, তাঁদের সব প্রোডাক্টেরই দুটি ভার্সন বা সংস্করণ আছে। বিনা মূল্যের সংস্করণেও অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। আর যেটি কিনতে হয়, সেটিতে বাড়তি অনেক সুবিধা আছে।
নিজাম ও তারেকের প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যারগুলো এখন বিভিন্ন ভাষাতেও অনূদিত হচ্ছে। যেমন দোকান এখন পর্যন্ত ৪৩টি এবং ডব্লিউপিইআরপি ২২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যদিও এখনো অনেক অনুবাদ অসম্পূর্ণ রয়েছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী স্বেচ্ছাসেবকেরা এই অনুবাদগুলো করছেন।
নিজাম ও তারেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞানে পড়ার সময় থেকে নিজেদের পণ্য বানাতে নেমে পড়েন। তাঁদের বানানো ওয়ার্ডপ্রেসভিত্তিক কয়েকটি প্লাগইন বিক্রি হতে শুরু করার পর তাঁদের আর পেছনে ফেরে তাকাতে হয়নি। ২০১৩ সালে পাস করে ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠা করেন উইডেভস ডট কম (www.wedevs.com)।
মিরপুরের উইডেভসের দুটি কার্যালয়ের পরিবেশ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। অফিসে ঢোকার পর কৃত্রিম ঘাসের প্লে-জোনে টেবিল টেনিস খেলারত কিংবা ঘাসে শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপে কাজ করার দৃশ্য দেখে আপনার মনে হতে পারে ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন। করোনাকালে তাঁদের কার্যালয় সাড়ে ৪ হাজার বর্গফুট থেকে ৯ হাজার বর্গফুটে সম্প্রসারিত হয়েছে। কর্মিসংখ্যা বেড়ে হয়েছে শতাধিক। তারেক-নিজামের ভাষ্য, তাঁদের কর্মীরাই তাঁদের আসল সম্পদ। এ জন্য স্টার্টআপ হলেও কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনি আছে মুনাফা শেয়ারেরও ব্যবস্থা। কর্মীদের জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে ট্যুর, ফ্যামিলি গেট-টুগেদার প্রভৃতি।
দোকান ও ইআরপি ছাড়াও তাদের আছে ওয়ার্ডপ্রেসভিত্তিক প্রজেক্ট ম্যানেজার, উইডক্স, ইউজার ফ্রন্টঅ্যান্ডের মতো প্রোডাক্ট। এ ছাড়া এই করোনাকালে তৈরি করা হয়েছে অ্যাপসেরো, যা দিয়ে তাদের মতো যারা প্লাগইন বা টেমপ্লেট বানায় তাদের গ্রাহকদের মনিটরিং, লাইসেন্স ডেপ্লয় করা সহজ হয়। এরই মধ্যে এটির ব্যবহারকারীও হাজার ছাড়িয়েছে।
এ ছাড়া ব্লকচেইনভিত্তিক ডিসেন্ট্রালাইজ পারসোনাল গ্রোথ প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছেন তারেক-নিজাম। ২৩টি ভাষায় দুই হাজারের বেশি পরামর্শ এক ছাতার নিচে আনার জন্যও কাজ করছেন তাঁরা। নিজামের আশাবাদ, কয়েক মাসের মধ্যে এই প্ল্যাটফর্মটি উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে।
আগামী দিনে বাংলাদেশে থেকে বিশ্বমানের সফটওয়্যার বানানোর ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, বিগডেটা নিয়েও কাজ চালিয়ে নিতে চান নিজাম উদ্দিন ও তারেক হাসান। নানা রকম চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কর্মীদের সুখী রাখার প্রত্যাশায় তাঁরা তাঁদের উইডেভসকে বিশ্বের ১ নম্বর সুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চান।
মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান প্রধান