অলিগলি পেরিয়ে মধুবাগ ১৫/৯ নম্বর বাড়ি। নিচতলায় মাঝারি আকারের তিনটি কামরা। ঢুকতেই চমক। কোনো ঘরে ঝুলছে লেডি বাগ, ওয়ান্ডার উইমেন, গ্রাফেলো, লিটল রেড রাইডিং হুডের পোশাক। কোনো ঘরে হ্যালোইন উৎসবের নানা সাজের মুখোশ। আছে ‘ক্যাটারপিলার’ গল্পের (শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠা) সিরিজও।
আরেক ঘরে আবার ভেংচি কাটছে বানরের মুখ, বসে আছে আদুরে বিড়াল, সাহসী কুকুর অথবা পাখনা মেলা প্রজাপতি। একপাশে রাজু আর মীনা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আরেক পাশে সিনড্রেলা আর হ্যারি পটার।
এখানে নানা সংস্কৃতির বন্ধুত্ব। শিশুদের মজার মজার চরিত্র একে অন্যের হাত ধরে দিব্যি বসে রয়েছে। দেশ নিয়ে, জাতি নিয়ে কোনো ঝগড়া নেই ওদের। মজার এই দুনিয়ার নাম সূর্যমুখী। মধুবাগের তিন কামরার বাড়িটা ছেড়ে সূর্যমুখী রাজ্যের বন্ধুরা পাড়ি দেয় সাত সাগর, তেরো নদী। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা আর নেদারল্যান্ডসের সাহেবি স্কুলে বিভিন্ন শোতে দারুণ পারফরম্যান্স ওদের। হ্যালোইন আর বড়দিনের উৎসবও মাতিয়ে রাখে বাংলাদেশে তৈরি এই পুতুলগুলো। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্কুলের শোতে শিশুদের মাতিয়ে রাখে।
অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা নেদারল্যান্ডসের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার স্কুলগুলোয় (আরলি চাইল্ড এডুকেশন) মিশ্র সংস্কৃতির শিক্ষা (মাল্টিকালচারাল এডুকেশন) প্রচলিত আছে। সেখানে শিশুরা সূর্যমুখীর তৈরি আরব দেশের জোব্বা, চাইনিজ কিপাও, জাপানি কিমানো ও স্প্যানিশ পোশাক পরে। পরে আমাদের ডোরাকাটা শাড়ি। সেটাও সূর্যমুখীর বানানো।
দেশের ভেতরে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতেও সূর্যমুখীর হস্তশিল্প বেশি যায়। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (আইএসডি), মোহাম্মদপুরের গ্রিন হেরাল্ড স্কুল, ধানমন্ডির ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুল, গুলশানে চিটাগাং গ্রামার স্কুলের বিভিন্ন মেলা, শো, বার্ষিক অনুষ্ঠানে সূর্যমুখীর হ্যান্ডপাপেট, কস্টিউম ও পুতুল বেশ জনপ্রিয়। আমেরিকান অ্যাম্বাসি, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন ও ব্রিটিশ হাইকমিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও সূর্যমুখীর হস্তশিল্পের কদর যথেষ্ট।
সূর্যমুখীর পথচলার গল্পটা জানালেন এর কর্ণধার নাজনীন আনসারী। নেদারল্যান্ডসের নাগরিক স্টান্স স্টলটির কাছে হাতেখড়ি নাজনীনের। কর্মসূত্রে ১৯৯৪ সালের দিকে বাংলাদেশে আসেন স্টান্স স্টলটি। তাঁর কাছ থেকে নাজনীন শেখেন হ্যান্ডপাপেট, কস্টিউম ও মুখোশের কাজ। হাতের কাজ বা সেলাই জানতেন আগে থেকেই। নতুন এই কাজ শেখার পর মাথায় আসে নতুন ভাবনা। ১৯৯৫ সালের দিকে রাজধানীর কালাচাঁদপুর অ্যাসোসিয়েশনের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাত নারীর সঙ্গে গড়ে তোলেন অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু শুধু তৈরি করলেই তো হবে না, চাই কাজের স্বীকৃতি, প্রচার, প্রসার।
স্টান্স স্টলটির গুলশান ১ নম্বরের বাসায় শুরু হলো সেই কাজ। ‘কফি মর্নিং শো’তে নাজনীনদের অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি হ্যান্ডপাপেট, কস্টিউম আর মুখোশের প্রদর্শনী শুরু হলো। সেখানে স্টান্সের বন্ধুরা এলেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের নাগরিক। অনেকে পছন্দ করলেন, কিনলেন। নিজের দেশে নিয়েও গেলেন। এরপর সূর্যমুখী সৌরভ ছড়াতে শুরু করল।
১৯৯৯ সালের দিকে বনানীতে বড় শোরুম করলেন নাজনীন ও তাঁর সঙ্গীরা। বস্তি থেকে আরও নারী ও পুরুষদের প্রশিক্ষণ দিলেন। হাতি, ঘোড়া ও পুতুল বানানোতেই থেমে থাকলেন না; বানাতে শুরু করলেন হ্যারি পটার, সিনড্রেলা, রবিন হুড, ফায়ার ম্যান। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে প্রচুর ফরমাশ আসতে শুরু করল। পেলেন এক্সপোর্ট লাইসেন্স। জমে উঠল সূর্যমুখী। তবে চাঁদাবাজদের অত্যাচার বেড়ে গেল। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলার পর রপ্তানিতেও ভাটা পড়ল। তাই বনানীর শোরুম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। এরপর শ্বশুরের পুরোনো এই মধুবাগের বাড়িতে নতুন করে আবার শুরু। বাধা কাটিয়ে আবার মুখ তুলল সূর্যমুখী।
সূর্যমুখীর ব্যবস্থাপক জাহিদ হাসান জানান, সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটস ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দেশের নানা ফরমাশগুলো পাওয়া যায়। যেকোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে ফরমাশ করতে পারে। এ ছাড়া বাইরের ফরমাশগুলো ই-মেইলের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন তাঁরা। হ্যালোইন ও বড়দিনের উৎসবে কাজের চাপ বেড়ে যায়। সূর্যমুখীর বানানো হ্যালোইনের মুখোশ, ব্যাগ ও কস্টিউম বেশ জনপ্রিয় বিদেশে। বড়দিন উপলক্ষে সান্তা ক্লজ ও ক্রিসমাস ট্রি বানান তাঁরা। সেগুলোও রপ্তানি করা হয়। জাহিদ হাসানের স্ত্রী তাজনীন বেগমও পাপেট বানান এখানে।
সূর্যমুখীর বেশির ভাগ কর্মীই পুরোনো। কেউ ৭ বছর, কেউ ১০ বছর ধরে কাজ করছেন এখানে। মো. রেজাউল মণ্ডল জানান, আগে তিনি গ্রামে ব্লাউজ সেলাই করতেন। এখন হ্যালোইনের কস্টিউম বানান। বিজয়া মানখিন জানান, তাঁরা বাড়িতে বসেও হ্যান্ডপাপেট ও মুখোশ বানান। পরে সেগুলো কারখানায় এসে জমা দিতে পারেন। এটা বড় সুবিধা।
সহব্যবস্থাপক বিমল বর্মণ বললেন, তাঁরা পাপেট থিয়েটারও করেন। ফ্রেঞ্চ স্কুলে মীনা-রাজুর থিয়েটার পাপেট তৈরি করেছে সূর্যমুখী। এ ছাড়া স্কুলগুলোর কারিকুলাম অনুসারে সিরিজ তৈরি করা হয় হ্যান্ডপাপেট দিয়ে। যেমন: ‘মামা ফিঙ্গার, পাপা ফিঙ্গার হোয়ার আর ইউ’—এ ধরনের ছড়াগুলোর জন্য পুরো পাপেট পরিবার তৈরি করেছেন তাঁরা। সেগুলো দেশের ও দেশের বাইরের স্কুলগুলোয় শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর কাজে শিক্ষকেরা ব্যবহার করেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলোয় আজকাল বিভিন্ন থিম, যেমন: ফ্রোজেন ও স্নো হোয়াইট ব্যবহার করা হয়। সেগুলোও তৈরি করে সূর্যমুখী।
শিশুদের মজার বাংলা চরিত্রগুলো, যেমন: মীনা-রাজু, গোপাল ভাঁড়, আরব্য রজনীর গল্প, ঠাকুমার ঝুলি নিয়ে কাজ কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাজনীন আনসারী বলেন, এ আফসোস তাঁর নিজেরও আছে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেটের কারণে শিশুদের কাছেও পাশ্চাত্যের কার্টুন চরিত্রই বেশি জনপ্রিয়। তাই এ ধরনের কাজের ফরমাশই তিনি বেশি পান। আর রপ্তানির সময় তো চাহিদার বিষয়টা মাথায় রাখতেই হয়।