>চাল-ডালের পর এবার গরু। অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে নতুন নতুন ক্রেতা তৈরি হচ্ছে। আসছে নতুন বিনিয়োগ। করপোরেটরা জোর দিচ্ছে অনলাইন কেনাকাটার ওপর।
আলু-পটোলও যে অনলাইনে কেনা যায়, তা এই করোনাকাল শিখিয়ে দিল দেশের মানুষকে। বিশেষ করে রাজধানীবাসীকে।
এখন অনেকেই অনলাইনে কাঁচাবাজার সারছেন। ওষুধ কিনছেন। ইলেকট্রনিকস পণ্য, পোশাক, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা আগেই ছিল, যেখানে ভাটা পড়ে এপ্রিল-মে মাসে, জুনে আবার গতি ফিরেছে।
এমনকি যাঁরা এত দিন গরুর হাটে গিয়ে শিং দেখে, দাঁত দেখে, সঙ্গে দু-একটা গুঁতো খেয়ে গরু কিনতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের একাংশ অনলাইনেই গরু দেখা শুরু করেছেন। ঘরে বসে পছন্দ করছেন খামারে থাকা গরু।
সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে সুসময় দেখছেন ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁদের মতে, অনলাইনে কেনা ও লেনদেনের যে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, তার একটি অংশ ভবিষ্যতেও থাকবে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাহিম মাশরুর বলেন, ক্রেতাদের একটা বড় অংশের অনলাইনে কেনাকাটার অভিজ্ঞতা ছিল না। করোনাকালে তাঁরা অনলাইনে পণ্য কিনেছেন। ফলে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তাঁদের একটা অংশ অনলাইনের ক্রেতা হিসেবে থাকবেন। তিনি বলেন, ‘সবার তো ক্রেডিট কার্ড নেই। তবে অনেকেরই মুঠোফোনভিত্তিক আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাব খোলা আছে। আমরা দেখছি, এখন আমাদের লেনদেনের ৪০ শতাংশের মতো হচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে। এটা করোনার আগে ২০ শতাংশ ছিল।’
বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। ওই বছর দুটি ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমত, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রিজি) চালু করে।
এরপর চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (ফোরজি) চালু হয়েছে। মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। অন্যদিকে ই-কমার্স খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ এসেছে। সব মিলিয়ে খাতটি বড় হয়েছে। ক্রেতা বেড়েছে।
ই-ক্যাবের হিসাবে, তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০। বছরে বিক্রির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকার মতো। অবশ্য এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছোট ছোট পণ্যবিক্রেতা রয়েছেন। আবার দোকানমালিকেরা অনেকেই অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন। তাঁদের অনেকেই আবার সুপরিচিত অনলাইন মার্কেট প্লেস বা কেনাবেচার মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত।
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা জার্মান ওয়েব পোর্টাল স্ট্যাটিস্টা গত মে মাসে বৈশ্বিক ই–কমার্স ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরে চলতি জুলাই মাসে তারা আবার সেটি হালনাগাদ করে। স্ট্যাটিস্টার হিসাবে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক ই–কমার্স ব্যবসার বাজারের আকার দাঁড়াবে দুই লাখ কোটি ডলার। সবচেয়ে বড় বাজার চীন। এরপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি।
স্ট্যাটিস্টার পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশে ই–কমার্সের আকার দাঁড়াবে ১৯৫ কোটি ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এটা তাদের পূর্ববর্তী পূর্বাভাসের চেয়ে কম। আগে তারা বলেছিল, চলতি বছর বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বিক্রির পরিমাণ ২০৭ কোটি ডলারের বেশি হবে। স্ট্যাটিস্টা করোনাকে মাথায় নিয়ে তাদের নতুন প্রক্ষেপণ তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের অনেকেই স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তবে করোনাকালে ই-কমার্স খাত যে সমস্যায় পড়েছে, সেটা তাঁরাও জানাচ্ছেন।
দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হয়। তখন অনলাইনগুলো দুটো সমস্যায় পড়ে। একটা হলো, সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়া। দ্বিতীয়টি, চাহিদা কমে যাওয়া। অনলাইনে সাধারণত যেসব পণ্য বিক্রি হতো, এপ্রিল-মে মাসে সেগুলোর চাহিদা কমে যায়। এর মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, পোশাক ইত্যাদি। ডেলিভারি পারসনদের অনেকেই গ্রামের বাড়িতে চলে যান। আবার পণ্যের উৎসগুলো বন্ধ হয়ে যায়। উপজেলা বা গ্রামে পণ্য কেনাকাটার যে প্রবণতা ছিল, সেটা থমকে যায়।
প্রচলিত পণ্যের বিপরীতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয় মুদি ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের। ফরমায়েশের চার-পাঁচ গুণ বৃদ্ধি সামাল দিতে ব্যাপক সংকটে পড়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বেশির ভাগের ব্যবসা আবার বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
এখন অবশ্য পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। যেমন দেশের শীর্ষস্থানীয় ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম দারাজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ ব্যবস্থাপক সায়ন্তনী তৃষা জানাচ্ছেন, তাঁদের ব্যবসা এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। এত দিন মুদি ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের চাহিদা বেশি থাকলেও ইলেকট্রনিকস পণ্যের চাহিদা কমে যায়। তাঁদের রাজস্বের সিংহভাগ আসে ইলেকট্রনিকস পণ্য থেকে।
ভবিষ্যতের বাজার ধরতে দারাজ বাংলাদেশে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলেও জানান সায়ন্তনী তৃষা। উল্লেখ্য, দারাজ ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৮ সালে চীনের আলিবাবা এটিকে অধিগ্রহণ করে। তারা জানিয়েছে, নতুন বিনিয়োগের সিংহভাগ তারা সরবরাহ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করবে। ৬৪টি জেলায় ১৫০টির বেশি কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে দারাজ।
অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা এখন প্রতারণা। ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করছেন না। সে ক্ষেত্রে যারা ক্রেতাদের ভালো সেবা দিচ্ছে, তারাই ভালো করবে বলে মনে করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, করোনাকালে যাঁরা একবার অনলাইনের মাধ্যমে কোনো ঝামেলা ছাড়া ঘরে বসে তাঁদের প্রয়োজনীয় পণ্যটি পেয়েছেন, তাঁরা আবার কেনার জন্য অনলাইন মাধ্যমে আসছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই খাত আগামী দিনগুলোতে আরও ভালো করবে বলে আশা করা যায়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ই-কমার্স ব্যবসা অথবাডটকম করোনাকালে আগের চেয়ে তিন গুণ পণ্য কেনাবেচা করেছে। তারা জানিয়েছে, এ সময়ে ক্রেতারা সবচেয়ে বেশি কিনেছেন মাস্ক, জীবাণুনাশক, হ্যান্ড গ্লাভস বা দস্তানাসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী। এরপরই রয়েছে পার্সোনাল কেয়ার পণ্য, ভোগ্যপণ্য, ব্যায়াম করার জন্য ট্রেডমিল ও বিভিন্ন ধরনের ফল। বাইসাইকেলের চাহিদাও বেড়েছে।
দেশের করপোরেটগুলোও বুঝতে পেরেছে যে আগামী দিনগুলোতে অনলাইনভিত্তিক বাজার বড় হবে। এ জন্য তারাও জোর দিচ্ছে অনলাইনভিত্তিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হতে। ফলে একটা প্রশ্ন সামনে আসছে যে ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিপুল ব্যয়ে ভবনের স্পেস বা জায়গা ভাড়া নিয়ে দোকান খোলার প্রবণতা কি আগের মতো থাকবে, নাকি সেখান থেকে খরচ কমিয়ে ক্রেতাদের অনলাইনে আরেকটু কম দামে পণ্য সরবরাহ করবে করপোরেটরা।
অনেকে বলছেন, তাঁরা তাঁদের স্টোরগুলোকে এখন অনলাইন বিক্রির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করছেন। ধরা যাক, গুলশান এলাকায় কেউ পণ্যের ফরমাশ দিয়েছেন। তাঁকে ওই এলাকার কোনো স্টোর থেকে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
স্যামসাং ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের বিপণনপ্রধান মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দীন বলেন, করোনার আগে তাঁদের মোট বিক্রির ১ থেকে ২ শতাংশ হতো অনলাইনে। এখন সেটা ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা অনলাইনে জোর দিচ্ছি। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি।’
করোনাকালের আগে দেশের মোট মুঠোফোন গ্রাহকের মাত্র ৩৫ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ছিল। সেটা আগামী দিনগুলোতে বাড়বে। গত মাসেই জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ সংশোধন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের পথ খুলে দিয়েছে।
দেশের মানুষ যদি কোরবানির গরু অনলাইনে কিনতে পারেন, তাহলে বাকি থাকবে কী? সুদিন আসছে কি না, দেখা যাবে আগামী দিনে। মনে রাখতে হবে, অন্য খাত যখন কর্মী ছাঁটাইয়ের চিন্তায়, ই-কমার্স তখন লোক নিয়োগ করছে।