ডিজিটাল মার্কেটিং

সফল তিন উদ্যোক্তার উদ্যোগ

মুনতাসির রশীদ, মহিউদ্দিন সরকার ও মঈন উদ্দিন
মুনতাসির রশীদ, মহিউদ্দিন সরকার ও মঈন উদ্দিন

তিন দশক আগে বিশ্বব্যাপী ওয়েবের আবির্ভাবের পর ব্যবসার জগৎ, বিপণন ও বেচাকেনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। দেড় দশক আগে অ্যাপলের আইফোন এসে সেই পরিবর্তনকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। এখন তো ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট ছাড়া কোনো সফল ব্যবসার কথা ভাবা এককথায় অসম্ভব। তাতেই ইন্টারনেটকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ইনবাউন্ড মার্কেটিংয়ের এক বিশাল জগৎ। কোটি কোটি ওয়েবসাইটের মধ্যে নিজেদের ওয়েবসাইটকে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে এক গোষ্ঠী। এদের কেউ কেউ তথ্য খোঁজার সার্চ ইঞ্জিনের উপযোগী করে তথ্যকে সাজায়। সেখানে নির্দিষ্ট কি-ওয়ার্ড দিলেই শুরুতেই চলে আসে উদ্যোক্তার ওয়েবসাইট। এ ব্যবস্থাটির নাম সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা এসইও। আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের ওয়েবসাইটের তথ্য ছড়িয়ে দেয়। যেটিকে বলা হয় সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং বা এসএমএম। আবার কেউ কেউ পুরো ডিজিটাল জগৎ নিয়ে কাজ করে। এই কাজের সিংহভাগেই থাকে কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখা ও প্রকাশের কাজ। এর মধ্যে শুধু এসইওর বৈশ্বিক বাজার ২০২১ সালে ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

এই কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় করার অনেক কাজ এখনো বাকি। আর এই ক্ষেত্রে কাজ করছেন বাংলাদেশের তিন উদ্যোক্তা—মুনতাসির রশীদ, মঈন উদ্দিন ও মহিউদ্দিন সরকার। এর মধ্যে মুনতাসির ও মঈন থাকেন প্যারিসে। ২০২০ সালে করোনার কঠিন সময়ে তাঁরা গড়ে তোলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি স্বয়ংক্রিয় প্ল্যাটফর্ম পোস্টপেইস। প্রতিষ্ঠানটি প্যারিসে নিবন্ধিত। সম্প্রতি পোস্টপেইসের তিন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয় অনলাইনে।

পোস্টপেইসে শুরুর কথা বলতে গিয়ে মুনতাসির রশীদ বলেন, ‘কনটেন্ট মার্কেটিংয়ের জন্য বেশ কয়েকটা আলাদা টুলস বা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু সেগুলো এক জায়গায় না থাকায় কনটেন্ট রাইটিংয়ের পেশাদারি কাজটি অগোছালো ও সময়সাপেক্ষ। আমাদের উদ্দেশ্য, একটা সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে একজন কনটেন্ট মার্কেটার ও তার দল দৈনন্দিন সব কাজকে এক জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একত্র করবে। যেমন বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রতিবেদন। এসইওর যাঁরা কাজ করেন তাঁদের একটি বিষয়ের ধারণা ও প্রতিবন্ধীদের কার্যক্রম বিশ্লেষণের জন্য দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগে। আমাদের স্বয়ংক্রিয় মডিউলে সেটি মাত্র দুই মিনিটে করে দেওয়া সম্ভব। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মানসহ মোট ১৪টি ভাষায় এটি কাজ করে।’

এমন একটা স্বয়ংক্রিয় টুলের চাহিদা তরতর করে বাড়বে, সেটিই স্বাভাবিক। হয়েছেও তা–ই। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে চালু হওয়ার পর ৮৬টি দেশের ১১ হাজার ব্যবহারকারী এটি ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০০ জন অর্থ দিয়ে তাদের গ্রাহক হয়েছে। গত এক বছরে এই মডিউলটি ১ লাখ ২০ হাজার বিষয়ে স্বয়ংক্রিয় রিপোর্ট তৈরি করেছে।

অবশ্য এই তিন উদ্যোক্তার গল্পটি এত সহজ ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর–পরিকল্পনার ছাত্র মুনতাসির রশীদ ও তাঁর বন্ধু ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (সিএসই) মঈন উদ্দিন নানা রকম পণ্য ও সেবার কথা ভাবতেন। ২০১৬ সালে তাঁরা একটি ওয়েবভিত্তিক ভিডিও সম্পাদনার টুল তৈরি করে সেটি অনলাইনে বিক্রি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেশে পেপাল বা স্ট্রাইপের মতো পেমেন্ট প্রসেসর না থাকায় বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক বন্ধুর শরণাপন্ন হন। তবে ব্যক্তিগত হিসাব (অ্যাকাউন্ট) ব্যবসায় ব্যবহারের কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওই হিসাবটি বন্ধ করে দেয় পেপাল।

ওই সময় মুনতাসির রশীদ মালয়েশিয়ায় মাস্টার্স করতে চলে যান। সেখানেই মহিউদ্দিন সরকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। মালয়েশিয়ায় স্ট্রাইপ ও পেপাল দুটোই উন্মুক্ত থাকায় তাঁদের টাকাকড়ি লেনদেনের সমস্যা মিটে যায়। এ সময় ঢাকাতে মঈন এবং মালয়েশিয়াতে মুনতাসীর ও মহিউদ্দিন মিলে ঠিক করেন,একদম নতুন কিছু করার। সে জন্য তাঁরা প্রেসমেটিক নামে একটি ‘নো-কোড’ প্ল্যাটফর্ম বানাতে ঝুঁকলেন। এটি হলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং বা কোডিং জানে না এমন যে কেউ একটি সফটওয়্যার তৈরি করতে পারবে। এই প্রকল্প নিয়ে তাঁরা ফরাসি সরকারের একটি স্টার্টআপ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এক বছরের ইনকিউবেশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।

দুই বছর পর তাঁরা বুঝতে পারলেন, যে কারও জন্য কোডিং ছাড়া সফটওয়্যার বানানোটা অনেক সময়সাপেক্ষ হবে। এ সময় তাঁরা প্ল্যাটফর্ম বানাতে না পারলেও তাঁরা নিজেরাই নিজেদের টুলস ব্যবহার করে সহজে সফটওয়্যার সলিউশন তৈরিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠলেন। তখন তাঁরা প্রেসমেটিককে একটি সফটওয়্যার স্টুডিওতে পরিণত করেন। কাজটি দ্রুত এগোতে থাকে। ঢাকায় ২০ জনের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং দলও গঠন করা হলো। তারপরই করোনার আঘাতে উদ্যোগটি বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনে থাকতে থাকতে তাঁরা কনটেন্ট মার্কেটিংয়ের স্বয়ংক্রিয়করণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার পরের গল্পটা আমরা প্রতিবেদনটির শুরুতে জেনেছি।

বর্তমানে পোস্টপেইসের আরও কয়েকটি ফিচার আছে। এর একটি হলো ইতিমধ্যে প্রকাশিত কনটেন্টেকে ১ হাজার ২৫০টি ম্যাট্রিক্সের বিপরীতে নিরীক্ষা করে সাজেশনের জন্য কনটেন্ট অডিট টুল। ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসর ব্যবহার করে তৈরি কনটেন্ট অপটিমাইজার লেখককে নির্দেশনা দেয়, কী করলে তার কনটেন্টটি গুগলের কাছে যথাযথ হবে। আছে কনটেন্ট লেখা ও প্রকাশের কনটেন্ট প্ল্যানার ও কনটেন্টসূচি।

মুনতাসির ও মঈনের ধারণা, ‘আলাদাভাবে প্রোগ্রামার ও ভোক্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য পণ্য ও সেবা ডিজাইনের কর্মী থাকে না। এর ফলে প্রোগামাররা সহজে ব্যবহার উপযোগী কার্যকর কিছু বানাতে পারে না।

এখন পর্যন্ত নিজেরাই তাঁদের উন্নয়নের পেছনের খরচ বহন করছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার মধ্যে আছে সিলিকন ভ্যালির অ্যান্ডারসন অ্যান্ড হরউইটজ, নিউইয়র্কের ইনসাইড পার্টনার্স ও লন্ডনভিত্তিক ইনরিচ ভেঞ্চার। এখনো তাঁরা তাঁদের প্রথম বিনিয়োগের ব্যাপারে মনস্থির করেননি। স্টেশন এফ-এর ফাউন্ডার্স প্রোগ্রামে থাকায় তাদের নেটওয়ার্কিং ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠছে বলে জানালেন মুনতাসির।

পোস্টপেইসের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা মঈন উদ্দিনের ইচ্ছে, কনটেন্ট রাইটিংয়ের দৈনন্দিন কাজের ৮০ শতাংশ স্বয়ংক্রিয় করা। কনটেন্ট মার্কেটিংয়ে বৈশ্বিক বাজার এ বছর ৪০ হাজার ৭৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়করণের মাধ্যমে সেখানে ভাগ বসাতে চান মুনতাসির, মঈন ও মহিউদ্দিন।