ব্যাবিলন ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে ঐশ্বর্যবান আর সম্পদশালী শহর। প্রায় চার হাজার বছর আগে ইউফ্রেটিসের তীরে থাকা এই ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, দুর্ভেদ্য প্রাচীর, প্রশস্ত রাস্তা, অপরূপ উপাসনালয়ের সঙ্গে সেখানকার বাসিন্দারাও ছিল তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তবান লোক।
আর সবচেয়ে ধনবান ছিলেন আরকাড। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি কিছুই পাননি, হঠাৎ ভাগ্যের জোরেও না। তিনি নিছকই এক সাধারণ লিপিকার ছিলেন। সম্পদশালী হওয়ার প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে ধাপে ধাপে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে অর্থ বৃদ্ধি করে গিয়েছিলেন।
ব্যাবিলনবাসীকে উদারভাবেই সাতটি সাধারণ অথচ কার্যকরী নিয়মের ব্যাপারে জ্ঞান বিতরণ করেছিলেন আরকাড, অন্যরাও যেন তা জেনে উপকৃত হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এই নিয়মগুলো এত হাজার বছর পরে এসেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কী ছিল আরকাডের সম্পদ বৃদ্ধির সেই সাত নিয়ম?
১. এক-দশমাংশ সঞ্চয়
তরুণ আরকাডকে তার খরিদ্দার অ্যালগামিশের দেওয়া একটা উপদেশই তাঁর পুরো জীবন পাল্টে দিয়েছিল: ‘যত ক্ষুদ্র অর্থই উপার্জন করা হোক না কেন, তার অন্তত ১০ ভাগের ১ ভাগ যেন সব সময় নিজের জন্য আলাদা রেখে দেওয়া হয় প্রথমেই।’
নিজে চলতে বা সংসার চালাতে যত কষ্টই হোক, ১০ ভাগের এই ১ ভাগটুকু যেন প্রথমেই আলাদা করে রাখা হয়। নিজেকেই নিজে পারিশ্রমিক দেওয়া এটা। এই সঞ্চিত অর্থ বাড়তে থাকলে নিজের ভেতরে সাহস আর তৃপ্তি আপনা থেকেই বাড়ে। আর ভবিষ্যতে আয় বাড়তে থাকলেও এই এক–দশমাংশ পৃথক করে রাখার নিয়ম যেন জারি থাকে।
২. বুঝেশুনে ব্যয়
একেকজন তো আমরা একেক অঙ্কের অর্থ উপার্জন করি। তবে প্রায় সবাই কেন মাস শেষে অর্থসংকটে ভুগি? কারণটা হলো, কোনটি প্রয়োজনীয় ব্যয় আর কোনটি নিছক চাহিদা বা বিলাসিতা, সেটার মধ্যে পার্থক্যটুকু করতে পারি না বলেই।
নিত্যকার খরচ কোন কোন খাতে হচ্ছে, দু-এক মাস ধরে লিখে রাখতে হবে কোথাও। নিজেই বুঝে যাবেন, কোন খরচটা আসলেই ‘প্রয়োজনীয়’ এবং সেটা চলতি খরচের জন্য রাখা ওই ৯ ভাগ অর্থ দিয়ে মেটানো যাবে কি না। ওই ৯ ভাগ দিয়ে যেভাবেই হোক মাসিক খরচাপাতি সেরে ফেলা শিখতে হবে।
৩. সঞ্চয়ের পর বিনিয়োগ
কেবল সঞ্চয় করে গেলেই অর্থ বাড়ে না, এ জন্য বিনিয়োগও করতে হয়। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই সুচিন্তিতভাবে। যাঁরা অর্থ লেনদেনবিষয়ক প্রকৃত জ্ঞানী অথবা বিনিয়োগের পথে আগে হেঁটে সফলতা পেয়েছেন, কেবল তাঁদেরই কাছ থেকে সুপরামর্শ নিতে হবে।
৪. লোকসান থেকে সাবধান
সব সময় শর্টকাটে অর্থ উপার্জনের হাতছানি থাকেই। যে অর্থ দ্রুত আসে, দ্রুতই তা চলে যায়। বন্ধু বা আত্মীয়দের পরামর্শে এসব ফাঁদে বোকার মতো পা দেওয়া উচিত নয়। হুজুগে মেতে সঙ্গ দোষেও পড়া যাবে না। বিনিয়োগের প্রথম শর্ত মূলধনের সুরক্ষা। যদি কাউকে ধার দিতেও হয়, সে ব্যক্তি ধার শোধের সক্ষমতা রাখে কি না, কষ্টিপাথরে তা যাচাই করে নিতে হবে অবশ্যই।
যে ধরনের ব্যবসা বা বিনিয়োগ নিয়ে নিজের ধারণা কম আর জ্ঞানীরা এড়িয়ে চলতে বলেন, সে পথে না যাওয়াই শ্রেয়তর। নিজের সঞ্চয় আর বিনিয়োগ—দুটিই সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় সব শিক্ষা ও ব্যবস্থা নিজেকেই নিতে হবে।
৫. নিজ হাতে গড়া কাঁচা ঘর, খাসা
উপার্জনের যে ৯ ভাগ অর্থ দিয়ে চলতি খরচ চালানোর কথা, সেখান থেকেও কোনো একটা অংশ যদি লাভজনক বিনিয়োগে কাজে লাগানো যায়, তবেই তরতর করে বাড়তে থাকে নিজের সম্পদ। এই বিনিয়োগ হতে পারে কোনো জমি কিংবা বাসা। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তা যেন লাভজনক হয়। আর্থিক সক্ষমতা বা ঋণ পরিশোধের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কেউ যদি জমি-বাসা কিনতে চায়, তখন বরং তা হিতে বিপরীত হবে।
৬. ভবিষ্যতের ভাবনা
ভবিষ্যতের জন্য আয়ের পথ নিশ্চিত করতে হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের ক্ষমতা কমতে থাকে। অবসর নেওয়ার পর যেন অন্য কারও মুখাপেক্ষী হওয়া না লাগে, সে জন্য সক্ষম থাকতেই পরিকল্পনা করতে হবে।
৭. উপার্জনের উপায় বৃদ্ধি
অনেকেরই অভিযোগ, প্রাপ্য মজুরি বাড়ানো হচ্ছে না। অথচ নিজের দক্ষতা বা পরিশ্রম বাড়িয়ে নিজেকে অপরিহার্য সম্পদ হিসেবে দাঁড় করানোর তাড়না কম। সুতীব্র এবং সুনির্দিষ্ট ইচ্ছাশক্তিই নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধির জন্য প্রধানতম নিয়ামক। পরিশ্রম আর ধৈর্য নিয়ে নিজের কাজের ব্যাপারে যত দক্ষতা আর জ্ঞান কেউ অর্জন করতে পারবে, ততই তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। একই সঙ্গে তার উপার্জনও বাড়তে থাকে। আরকাডও জানতেন, আয়ের জন্য বেশ কটি উপায় বের না করলে অনেক ধনবান ব্যক্তির অর্থও দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। কেবল অর্থ থাকলে তা দ্রুত ফুরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অর্থ পরিচালনা নিয়ে জ্ঞান থাকলে অর্থ বৃদ্ধি পায়।
শেষ কথাটা তাই খুব ছোটই: আয়ের একটা অংশ নিজের জন্য রাখো।
সূত্র: দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন ব্যাবিলন-জর্জ ক্লেসন
প্রিয়ম মজুমদার: সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্যাভিলিয়ন