সরকারি সংস্থা

শ্রম বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বিটাক

পাঁচ দশকে মাত্র চারটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র করতে পেরেছে বিটাক। নতুন কেন্দ্র স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশ সাত বছরেও পালিত হয়নি।

উদ্যোক্তারা বছরের পর বছর ধরে কলকারখানায় কাজ করার মতো দক্ষ জনবল না পাওয়ার কথা বলে আসছেন। অথচ কলকারখানায় কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে দেশে প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো যে প্রশিক্ষণ সংস্থা রয়েছে, সেটি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না। বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) নামের এই সরকারি সংস্থাটির গাফিলতির কারণে শিল্পকারখানাগুলো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোক পাচ্ছে না। এ জন্য তাদের ভারী যন্ত্রপাতি চালাতে বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে উচ্চ বেতনে অভিজ্ঞ লোক আনতে হচ্ছে।

বিটাকের জন্ম ১৯৭২ সালে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই সংস্থা। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে বিটাক প্রতিষ্ঠা করা হলেও গত পাঁচ দশকে এটি সারা দেশে মাত্র চারটি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ক্ষুদ্র ও ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা শেখানো হয়। একই সঙ্গে আমদানি বিকল্প যন্ত্রাংশও তৈরি হয়। তবে দুটিই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এদিকে বিটাকের দেড় দশক পর যাত্রা শুরু করা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) একেক করে আটটিতে উন্নীত হয়েছে। আর ৩৮ বছর পর চালু হওয়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদিত হয়েছে ৯৭টি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। ৩৩ হাজার একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে দেশের বৃহত্তম এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। আরও বেশ কটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বিটাক এখনো সেই কবেকার চারটি আঞ্চলিক কেন্দ্র নিয়েই পড়ে রয়েছে।

বিটাকের চারটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হচ্ছে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা ও বগুড়ায়। কেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষদের ২৮টি বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৮২ জনকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে যেসব বিভাগে বিটাকের প্রশিক্ষণকেন্দ্র নেই, সেখানে প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশনার সাত বছর পেরিয়ে যেতে চলেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব বিভাগে প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করতেই পারেনি বিটাক। বিটাকের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, গোপালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর, জামালপুর ও যশোর—এই ছয় জেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে, যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়।

প্রকল্প তৈরিতে পদে পদে দেরি হচ্ছে। আঞ্চলিক কেন্দ্র করার মতো জমি পাওয়া, স্থান নির্ধারণ, নকশা চূড়ান্ত—এসব কাজ করতে অনেক সময় চলে গেছে।
আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মহাপরিচালক, বিটাক

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ২০১৪ সালের নির্দেশ কেন ২০২১ সালেও বাস্তবায়িত হয়নি, তা জানতে চাইলে বিটাকের মহাপরিচালক (ডিজি) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি প্রকল্প অনুমোদনে এত দেরি হওয়ায় আমি নিজেও সন্তুষ্ট নই।’ দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প তৈরিতে পদে পদে দেরি হচ্ছে। আঞ্চলিক কেন্দ্র করার মতো জমি পাওয়া, স্থান নির্ধারণ, নকশা চূড়ান্ত—এসব কাজ করতে অনেক সময় চলে গেছে। আশা করছি, শিগগিরই প্রকল্পটি একনেক সভায় পাস হবে।’ তিনি মনে করেন, সারা দেশে নতুন করে আরও কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে।

আনোয়ার হোসেন চৌধুরী মনে করেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নতুন ছয়টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যদিও কবে নাগাদ প্রকল্প অনুমোদিত ও বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

বিটাকে স্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদে মহাপরিচালক না থাকাও ছয়টি নতুন আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণে তেমন অগ্রগতি না হওয়ার বড় কারণ। যেমন প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে যখন বিটাকের আঞ্চলিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র বাড়ানোর নির্দেশ দেন, তখন এই সংস্থার মহাপরিচালক (ডিজি) ছিলেন আবদুল মতিন। তিনি প্রতিটি আঞ্চলিক কেন্দ্র তিন একর জায়গার ওপর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ছয়টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের জন্য জায়গাও চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে বিটাকের নতুন ডিজি হিসেবে এসে মফিজুর রহমান আগের সব পরিকল্পনা বাতিল করেন। তাঁর নির্দেশে পাঁচ একর করে জমি খোঁজা শুরু হয়।

আঞ্চলিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণের জায়গাও একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়। এর মধ্যে রংপুরে যে কেন্দ্র হওয়ার কথা, সেটি সৈয়দপুরে করার সিদ্ধান্ত নেয় বিটাক। পরে আবার ওই কেন্দ্র রংপুরে নিয়ে আসা হয়। ময়মনসিংহে যে কেন্দ্র হওয়ার কথা, সেটি নেওয়া হয় জামালপুরে। এভাবে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পাল্টাতে অনেক সময় চলে যায়। ইতিমধ্যে জমি এবং সেই সঙ্গে রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দামও বেড়েছে।

বিটাকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি এই সংস্থার শীর্ষ পদে মহাপরিচালকেরা আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকেন। তাই দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা থাকে না। তা ছাড়া বিটাকের যে সম্ভাবনা ও সক্ষমতা, তা কখনোই শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে গুরুত্ব পায় না। ফলে দক্ষ জনবল তৈরিতে বিটাক কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে। দেশে এখন ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ। বিশাল এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে যতটা হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার কথা, ততটা দিতে পারছে না সরকার।

গত বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বিটাকের সদর দপ্তরে পাওয়া গেল আহ্‌ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে, যাঁরা সেখানে এসেছিলেন থিসিসের কাজে। এর মধ্যে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শিহাব শাকুর বলেন, বিটাকের সম্ভাবনা ব্যাপক। কিন্তু সক্ষমতার পুরোটা তারা ব্যবহার করতে পারছে না।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) শরিফা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিটাক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেকের। সংস্থাটির আরও আঞ্চলিক কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে।