এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার

শ্রমিকেরা ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারছেন না

>
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
তৈরি পোশাকশ্রমিকদের জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে তারা পোশাকশিল্পের জন্য নিম্নতম মজুরি প্রস্তাব করেছে ১০ হাজার ২৮ টাকা। তবে শ্রমিকনেতারা বলছেন, সিপিডির প্রস্তাব বাস্তবসম্মত হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে গত বুধবার কথা বলেছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: পোশাকশ্রমিকদের জীবনযাত্রা নিয়ে আপনারা গবেষণা করেছেন। তো বর্তমান মজুরিতে শ্রমিকেরা কেমন আছেন? তাঁরা কি তাঁদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারছেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: শ্রমিকেরা বর্তমানে যে আয় করেন, তার বিপরীতে ব্যয় অনেক বেশি। একজন শ্রমিকের পরিবারের গড়পড়তা মাসিক ব্যয় এখন ২২ হাজার ৪৩৫ টাকা। তার বিপরীতে শ্রমিকের আয় অর্ধেকেরও কম। এই আয় দিয়ে এককভাবে পরিবারের ব্যয় মেটানো অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের আয় দিয়ে তিনি পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। পরিবারের ব্যয় অসম্ভব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির চেয়েও পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি অনেক বেশি। তবে আমাদের গবেষণায় এসেছে, শিল্প এলাকায় মূল্যস্ফীতিজনিত ব্যয় বেশি। সে হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের মূল্যস্ফীতি এখানে বিবেচনার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উচিত হবে শিল্প এলাকার জন্য আলাদা মূল্যস্ফীতি হিসাব করা ও প্রকাশ করা, যেটি তারা আগে করত। আমরা যেটি দেখতে পেয়েছি, ১৬ শতাংশ শ্রমিকের ঘরে ফ্যান নেই। ১৭ শতাংশ খাট ছাড়াই ঘুমান। ৪০-৪৪ শতাংশ শ্রমিকের ঘরে টেবিল-চেয়ার নেই। মাত্র ২৪ শতাংশের ঘরে ফ্রিজ আছে। ৬৫ শতাংশের ঘরে টেলিভিশন রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশের ঘরেই এখনো এই সুবিধাগুলো পৌঁছায়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রমিকেরা ওপরের অথবা নিচের যে গ্রেডেই কাজ করুন না কেন, তাঁদের ব্যয়কাঠামো মোটামুটি অভিন্ন। তাতে বোঝা যায়, উচ্চ কিংবা নিম্ন গ্রেডের শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারেন না। তা ছাড়া নতুন যে বিষয়টি আমরা আবিষ্কার করলাম সেটি হচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ব্যয় মেটাতে শ্রমিকের বড় পরিমাণ ঋণ করতে হয়। এটা তাঁদের খাদ্যবহির্ভূত মোট ব্যয়ের ২২ শতাংশ। এখান থেকে বোঝা যায়, তাঁদের আয় পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণেই অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে। ২০১০ ও ২০১৩ সালে শ্রমিকের মজুরি সমন্বয়ের পরও নিম্নতম জীবনমান নিশ্চিত হচ্ছে না। এতেই বোঝা যায়, মজুরি ব্যাপক হারে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।

প্রথম আলো: এই যদি শ্রমিকদের অবস্থা হয় তাহলে মালিকেরা মজুরি বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমার কাছে মনে হয়, মালিকদের এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়াই উচিত হয়নি। বরং যৌক্তিক বিচারে যেসব মানদণ্ডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কথা বলা হচ্ছে, সেই মানদণ্ডে প্রস্তাবের চেয়ে বেশি মজুরি আসার কথা। তাই মালিকেরা অনেক কম প্রস্তাব দিয়ে শ্রমিকদের প্রয়োজনগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষা করছেন।

প্রথম আলো: আপনারা তো নিম্নতম মজুরি ১০ হাজার ২৮ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। সেটি কি বাস্তবসম্মত হয়েছে?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিপিডি পুরো বিষয়টিকে যৌক্তিক ও ন্যায্যতার জায়গা থেকে দেখে থাকে। সিপিডির সংলাপে যে বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে, তার ভেতরে শ্রমিকের জীবনমান নিয়ে গবেষণাকে সবাই প্রশংসা করেছে। অর্থাৎ জীবনমানের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেটিকে প্রকৃত চিত্র বলে সবাই স্বীকার করেছেন। সিপিডি জীবনমানের ভিত্তিতেই মজুরি কাঠামোয় আলোকপাত করেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি অংশ ছিল, তার মধ্যে একটি হচ্ছে বর্তমান মজুরিকাঠামোর অসামঞ্জস্য ও অন্যটি ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রস্তাব দেওয়া। অসামঞ্জস্যের ভেতরে সিপিডি দেখিয়েছে, আগের মজুরিকাঠামোতে বিভিন্ন গ্রেডে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল, মূল বেতনের অংশ কমানো হয়েছে। এর ফলে ওভারটাইম ও বোনাসের হার কমে গেছে। পাশাপাশি নতুন কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সিপিডির প্রস্তাবে শ্রমিকদের পরিবারের ব্যয় বিবেচনা শিশু বা শিক্ষা ভাতার প্রবর্তন, যাতায়াত ভাতা, মূল বেতনের ৩ শতাংশ হিসেবে সার্ভিস বেনিফিট ও পদোন্নতির সঙ্গে দক্ষতা অনুসারে বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। নিম্নতম
মজুরি ১০ হাজার ২৮ টাকা প্রস্তাব করা হলেও আমরা মনে করি, যে পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কম থাকে, তার জন্য এই কাঠামোটি পর্যাপ্ত নয়। আমরা প্রত্যাশা করব, আমাদের প্রস্তাবের সঙ্গে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির প্রস্তাব মিলিয়ে মজুরি বোর্ড আলোচনা করবে। তা ছাড়া শ্রমিকদের প্রয়োজনের একটা অংশের দায়দায়িত্ব সরকারের নেওয়া দরকার। বিশেষ করে স্বল্প খরচে বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে শ্রমিকেরা তাঁদের বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করতে পারবেন।

প্রথম আলো: নিম্নতম মজুরি বোর্ডে কম মজুরি প্রস্তাব করার বিষয়ে মালিকপক্ষের একটি যুক্তি ছিল, প্রতিযোগী অন্য দেশের চেয়ে আমাদের শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক কম, ৪০ শতাংশ। আপনারা গবেষণায় কী পেয়েছেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাকশ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা অনেক বেড়েছে। এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বড় ভূমিকা রেখেছে। সব মিলিয়ে শ্রমিকদের দক্ষতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ওভেন ও নিট কারখানায় তেমন পার্থক্য নেই। বাড়তি উৎপাদনশীলতা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করে।  

প্রথম আলো: শ্রমিকনেতাদের অভিযোগ, প্রতিবারই মালিকেরা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় নানা অজুহাত দেন। এটি কীভাবে বন্ধ করা যায়?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ন্যূনতম মজুরির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকা এবং জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত না থাকার বিষয়টি নানা কৌশলে ব্যবহার করা হয়। শ্রমিকদের প্রস্তাব অনেকটা বাস্তবানুগ হলেও মালিকদের প্রস্তাবে যৌক্তিকীকরণের সুযোগ থাকে। মালিকেরা যদি উৎপাদনশীলতা ও পরিচালনা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেন, তা হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়। এর সঙ্গে ক্রেতাদেরও যুক্ত করা যায়।