পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পাচারকে উৎসাহিত করবে বলেই মনে করেন বক্তারা।
নতুন বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপব্যয়ও করছে। যেমন আমলাদের বেতন অনেক বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের আবার মুঠোফোনও কিনে দেওয়া হচ্ছে। অথচ শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে সংসদ সদস্যরাও কিছু বলছেন না।
দেশে বৈষম্য বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ সময় শ্রমজীবী মানুষের জন্য রেশন ও স্বল্প মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে কিছুটা হলেও তাঁদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ আচরণ করা হতো।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে গতকাল রাজধানীর লেক শোর হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে আলোচিত দিক হচ্ছে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া। এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, দেশে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। কিন্তু এবার যে সুযোগ দেওয়া হলো, তাতে অনেকেই ভাবতে পারেন, ২৫ শতাংশ আয়কর না দিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচার করাই বরং ভালো। তখন ৭ শতাংশ কর দিয়ে টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, সরকার ঠিক কোন ধরনের অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করছে, তা বোধগম্য নয়। যাঁরা দেশে থাকছেন, বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থান তৈরি করছেন, তাঁরা ২৫ শতাংশ আয়কর দিচ্ছেন। আর যাঁরা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে টাকা পাচার করছেন, তাঁরা ৭ শতাংশ কর দিয়ে সেই টাকা বৈধ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতা রাজেকুজ্জামান রতন উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে শ্রমিকদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। বলেন, শ্রমিক-কৃষকেরা ভ্যাট দিচ্ছেন, উৎপাদন করছেন, কিন্তু তাঁরা বাজেটে নেই। তাঁদের সঙ্গে প্রাক্-বাজেট আলোচনা করা হয় না। দেশের শ্রমশক্তি ছয় কোটির বেশি হলেও এ বছর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বাজেট কমেছে।
মজুরি বৃদ্ধি করা না গেলে অন্তত শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার দাবি জানান রাজেকুজ্জামান রতন। এ ছাড়া তিনি খাসজমিতে শ্রমিকদের জন্য আবাসন নির্মাণের দাবি জানান। বলেন, শ্রমিকদের জন্য ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্মাণে আট লাখ টাকার মতো ব্যয় হবে। শ্রমিকেরা প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিলে ১৩ বছরে এ ব্যয় উঠে যাবে।
রাজেকুজ্জামান রতনের সঙ্গে একমত পোষণ করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও শ্রমিকেরা যা পান, আমাদের শ্রমিকেরা তা পাচ্ছেন না।’ শ্রমিকদের রেশন কার্ড দেওয়ার দাবির প্রতি সমর্থন জানান তিনি। তৈরি পোশাক ও ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের রেশন কার্ড দেওয়া যেতে পারে।
বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, সরকার কারসাজি করে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পরিসংখ্যান কারসাজি করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল বা কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করা যায় না। আর দেশের মানুষের ঘরে ঘরে যে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে বা মানুষের গড় আয়ু ৭০ পেরিয়ে গেছে, তা-ও পরিসংখ্যান কারসাজি করে অর্জন করা যায় না।
এ ছাড়া আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সরকারের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, একটি ‘অনির্বাচিত’ সরকারের বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তোলার অনেক অবকাশ আছে।
এর পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে এম এ মান্নান বলেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যে ‘অনির্বাচিত’ শব্দটি বললেন, তা ক্লিশে হয়ে গেছে। এই কথা শুনতে শুনতে জনগণের কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। বর্তমান সরকার অনির্বাচিত নয়, কার্যকর সরকার। তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা নির্বাচনে আসুন, জয়ী হয়ে ক্ষমতা নিন, তারপর সরকার পরিচালনা করুন।’
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেন। যেমন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) ভাইস প্রেসিডেন্ট সুস্মিতা আনিস বলেন, করপোরেট কর কমানো হয়েছে ঠিক, কিন্তু বলা হয়েছে, সে জন্য কোম্পানির বার্ষিক নগদ লেনদেন ১২ লাখ টাকার বেশি হতে পারবে না। এটা সম্ভব নয়। সংলাপে কেউ বলেন, বিদ্যুৎ খাতেও তৈরি পোশাক খাতের মতো বন্ডেড সুবিধা দিতে হবে। আবার কেউ বলেন, গ্রামের মতো শহরেও বিধবা ভাতা দেওয়া হোক।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। উপস্থাপনা করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আরও বক্তব্য দেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ প্রমুখ।