দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ‘ব্লক মার্কেটে’ লেনদেন বাড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার লেনদেনের প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ হয়েছে ব্লক মার্কেটে, যা পরিমাণে ৬১ কোটি টাকা। শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৮টি কোম্পানির। এদিন ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছিল ৮১৯ কোটি টাকা।
ডিএসইর গত কয়েক দিনের লেনদেনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল ব্লক মার্কেটের। এই লেনদেন নিয়ে তাই বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।
মূল বাজারের চেয়ে ব্লক মার্কেটের তফাত হচ্ছে মূল বাজারে ক্রেতা–বিক্রেতা থাকে একে অপরের অচেনা। সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবাই অংশ নেয় মূল বাজারের লেনদেনে। আর ব্লক মার্কেটে লেনদেনের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্রেতা–বিক্রেতা ও শেয়ারের দাম আগেই নির্ধারিত থাকে। শুধু শেয়ারের আনুষ্ঠানিক হাতবদলটা হয় এ মার্কেটে। আবার অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা নিজেদের এক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব থেকে অন্য বিও হিসাবে শেয়ার স্থানান্তর করেন ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে। আর্থিক হিসাবের (প্রান্তিক বা অর্ধবার্ষিক) সময় যখনই ঘনিয়ে আসে, তখনই ব্লকে লেনদেন বেড়ে যায়।
একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আর্থিক বিবরণী তৈরির সুবিধার্থে প্রান্তিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক হিসাব–নিকাশের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, তখন এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে শেয়ার হাতবদলের পরিমাণ বেড়ে যায়। মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এ কাজ করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, ‘এ’ একটি কোম্পানি। তারই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বি’ ও ‘সি’। এর মধ্যে ‘এ’ কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। ফলে নিয়ম অনুযায়ী, জুন শেষে ‘এ’ কোম্পানির বার্ষিক বা অর্ধবার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করতে হবে।
আবার ‘এ’ কোম্পানির হাতে তালিকাভুক্ত এক বা একাধিক কোম্পানির বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। এখন জুন শেষে আর্থিক হিসাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে ‘এ’ কোম্পানি বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি দামে তার হাতে থাকা কোম্পানির শেয়ার ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে ‘বি’ বা ‘সি’ কোম্পানিতে স্থানান্তর করে। এভাবে ‘এ’ কোম্পানির হিসাবে শেয়ার হাতবদল তথা বিক্রি বাবদ বড় অঙ্কের মুনাফা জমা হয়। আর তাতেই বাড়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস, যা পরবর্তী সময়ে শেয়ারের দামে প্রভাব ফেলে।
ডিএসইর ব্লক মার্কেটে গতকালের ৬১ কোটি টাকার লেনদেনের প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকাই ছিল দুটি ব্যাংকের। এর মধ্যে ১৪ কোটি টাকায় যমুনা ব্যাংকের ৬৫ লাখ শেয়ারের হাতবদল হয়। একটি বিক্রয়াদেশেই এ লেনদেন সম্পন্ন হয়। আর এই শেয়ারের হাতবদল হয় বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে। বাজারে গতকাল যমুনা ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ছিল ২১ টাকা ৭০ পয়সা। অথচ ব্লকে এদিন ব্যাংকটির শেয়ার হাতবদল হয়েছে ২২ টাকায়। একইভাবে ব্লকে উত্তরা ব্যাংকের ৬০ লাখ শেয়ার হাতবদল হয় ১৪ কোটি টাকায়। প্রতিটি শেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ২৩ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু ব্যাংকটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ২৩ টাকা ২০ পয়সা। সেই হিসাবে বাজারমূল্যের চেয়ে ৫০ পয়সা বেশি দামে ব্লকে ব্যাংকটির শেয়ার হাতবদল করা হয়েছে। তাতে যিনি বা যাঁরা এ শেয়ার বিক্রি করেছেন, তাঁর হিসাবে বাজারমূল্যের চেয়ে ৩০ লাখ টাকার বাড়তি মুনাফা যোগ হয়েছে। এভাবেই মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনেকে ব্লক মার্কেটে লেনদেন করে থাকে। তাতে নিজেদের মধ্যে শেয়ারের হাতবদল করে মুনাফা যেমন বাড়িয়ে দেখানো যায়, তেমনি শেয়ারও থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। উভয় দিক থেকেই লাভবান হয় সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা।
একইভাবে ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরাও এ পন্থায় লেনদেন করেন ঋণসুবিধা বাড়িয়ে নিতে। তাঁরা এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে বাড়তি দামে শেয়ার স্থানান্তর করে বিও হিসাবে বাড়তি মুনাফা দেখান। এর বিপরীতে পরবর্তী সময়ে বাড়তি ঋণসুবিধা নেন। কারণ, ঋণদাতা বেশির ভাগ ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক রিয়ালাইজড গেইন বা মূলধনি মুনাফার ওপর ভিত্তি করে ঋণসুবিধা দেয়। এ কারণে বড় বিনিয়োগকারীরা বেশি ঋণসুবিধা নিতে নিজেদের মধ্যে বড় অঙ্কের শেয়ার হাতবদল করে ব্লক মার্কেটে।
এ ছাড়া অনেক সময় শেয়ারবাজারের লেনদেন বাড়িয়ে দেখাতেও প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা ব্লকে নিজেদের মধ্যে শেয়ার হাতবদল করে থাকেন।