শেয়ারবাজারে কী কিনছেন, কেন কিনছেন

‘আপনি কী ধারণ করছেন সেটা জানুন, আরও জানুন কেন তা ধারণ করছেন।’ শেয়ারবাজার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালস্ট্রিটের বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারী পিটার লিঞ্চের বিখ্যাত উক্তি এটি। বিশ্বজুড়ে সব শেয়ারবাজারের সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর জন্যই কথাটি প্রযোজ্য। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এ দেশের বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই মনে করেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে এ দেশের বাজারের কোনো মিল নেই।

‘আপনি কী ধারণ করছেন সেটা জানুন, আরও জানুন কেন তা ধারণ করছেন।’ শেয়ারবাজার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালস্ট্রিটের বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারী পিটার লিঞ্চের বিখ্যাত উক্তি এটি। বিশ্বজুড়ে সব শেয়ারবাজারের সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর জন্যই কথাটি প্রযোজ্য। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এ দেশের বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই মনে করেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে এ দেশের বাজারের কোনো মিল নেই। কারণ, খারাপ শেয়ারের দাম খুব দ্রুত বাড়ে। আর ভালো শেয়ারের দাম বাড়ে ধীরে। এ কারণে বিশ্বজুড়ে মৌলভিত্তির কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি থাকলেও এ দেশে উল্টো। আসলেই কি তাই? তবে আসুন কিছু পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখি। দেখা যাক, সেখানে কী তথ্য মেলে।

সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের উপস্থিতিতে এক অনলাইন আলোচনায় একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, গত ১৯ মার্চ থেকে শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর (ফ্লোর প্রাইস) বেঁধে দেওয়ার পর থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এ দেশের বাজারে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে জিল বাংলা সুগার মিলসের। উল্লিখিত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৪০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল জিকিউ বলপেন। একই সময়ের ব্যবধানে ‘ইকোনো’ ব্র্যান্ডের কলমের জন্য বিখ্যাত এ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ২৩৭ শতাংশ।

এ দেশের বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই মনে করেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে এ দেশের বাজারের কোনো মিল নেই।

নিশ্চয় এখন ভাবছেন, খারাপ শেয়ারে বিনিয়োগেই তাহলে লাভ বেশি? তাহলে শেয়ারবাজারের কোম্পানি নিয়ে পিটার লিঞ্চের আরেকটি বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিই। তিনি বলেছেন, ‘বড় কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে ধীরে, ছোট কোম্পানির দাম বাড়ে দ্রুত’। যিনি বিক্রেতা তাঁর জন্য দাম বাড়ার খবর সব সময় আনন্দের। কিন্তু ক্রেতার জন্য এটা সব সময় দুঃসংবাদ। হোক সেটা শেয়ার কিংবা পণ্য। তাই দাম বাড়লে ছুটে গিয়ে সব শেয়ার কেনা উচিত নয়। কেন উচিত নয়? ফিরে যাই আবার জিল বাংলা সুগার ও জিকিউ বলপেনের কথায়। দুটি শেয়ার নিয়েই কারসাজির ঘটনার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাই জিল বাংলার লেনদেনই অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। আর জিকিউ বলপেনের শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১০টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির ক্রেতা উধাও হয়ে গিয়েছিল বাজার থেকে। এরপর ভেবে দেখুন খারাপ শেয়ারে বিনিয়োগে মুনাফা বেশি, নাকি ঝুঁকি বেশি। তিলে তিলে গড়া নিজের সঞ্চয়ের টাকায় যদি ঝুঁকি কিনতে চান, সেখানে বাধা দেয় সাধ্য কার?

২০১৬ সালে উল্লিখিত ১০ কোম্পানির বাইরে অন্যান্য শেয়ারে বিনিয়োগ করে যদি কোনো বিনিয়োগকারীর ১২ শতাংশ মুনাফা হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় মূলধনি ১০ কোম্পানিতে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের মুনাফা হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি।

ভালো শেয়ারে বেশি লাভ
এতক্ষণ মন্দ কোম্পানির গল্প হচ্ছিল। মন্দ ভুলে এবার ভালোর গল্পে আসুন। জেনে নিন কিছু ভালো কোম্পানির শেয়ারের পরিসংখ্যান। মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের এমডি বলছেন, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল—এ পাঁচ বছরে বাজার প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাজারে সবচেয়ে বড় মূলধন ও ভালো মৌলভিত্তির ১০ কোম্পানির। কোম্পানিগুলো হচ্ছে গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, ইউনাইটেড পাওয়ার, রেনেটা, আইসিবি, বার্জার পেইন্টস, ম্যারিকো, ব্র্যাক ব্যাংক ও লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট। ২০১৬ সালে যেখানে বাজারের সার্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ, সেখানে উল্লিখিত ১০ কোম্পানির সম্মিলিত প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ। বিষয়টি আরেকটু সহজ করেই বলা যাক। ২০১৬ সালে উল্লিখিত ১০ কোম্পানির বাইরে অন্যান্য শেয়ারে বিনিয়োগ করে যদি কোনো বিনিয়োগকারীর ১২ শতাংশ মুনাফা হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় মূলধনি ১০ কোম্পানিতে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের মুনাফা হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি। একই ভাবে ২০১৭ সালে যেখানে বাজার প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ, সেখানে সবচেয়ে বড় মূলধনি ১০ কোম্পানির শেয়ারের প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১২ শতাংশ।

আবার ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের তুলনায় দেখা যায়, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচকের (আগের সাধারণ সূচক ও এখনকার ডিএসইএক্স মিলিয়ে) প্রবৃদ্ধি ছিল শূন্য। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে সূচকটি যতটা বেড়েছিল, ঠিক ততটাই কমে গেছে। উত্থান-পতনের যোগ-বিয়োগের হিসাবে সূচকের প্রবৃদ্ধি শূন্য হয়ে যাওয়ার এ সময়ে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারে গড়ে প্রায় ২৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কোনো বিনিয়োগকারী যদি ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ কোম্পানির শেয়ার ধারণ করে থাকেন, তাহলে মূলধনি মুনাফা ও ঘোষিত লভ্যাংশ মিলিয়ে ওই বিনিয়োগকারী ২৪ শতাংশ মুনাফা পেয়েছেন। তাই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা যে ভালো শেয়ারে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন, সেটি এ কারণেই হয়তো দেন। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে বাজার প্রবৃদ্ধি হোক বা না হোক, ওই সব শেয়ারের বিনিয়োগকারীরা শেষ পর্যন্ত মুনাফার দেখা পাবেন।

বাংলাদেশে কি মৌলভিত্তি কাজ করে
শেয়ারবাজারের পরিসংখ্যান বলছে, অবশ্যই কাজ করে। তবে সেটি নির্ভর করে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় প্রবৃদ্ধির ওপর। যদি বাজারের বেশির ভাগ কোম্পানির আয় ভালো থাকে, তবে বাজারে সূচকেরও প্রবৃদ্ধি হয়। তবে কখনো কখনো কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত আয় প্রবৃদ্ধির চেয়ে সূচকের বেশি প্রবৃদ্ধি হলে সেটি খুব বেশি স্থায়ী হয় না। বাজারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সালে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয়ের সম্মিলিত প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ। তার বিপরীতে ওই বছর সূচকের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তালিকাভুক্ত সিংহভাগ কোম্পানির আয়ের প্রধান উৎস ছিল শেয়ারবাজার। নামে-বেনামে কোম্পানি ও তার সুবিধাভোগীরা বাজারে বিনিয়োগ করেন। শেয়ারবাজারের মুনাফা গিয়ে যোগ হয় কোম্পানির আয়ে। আবার অনেক কোম্পানি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখায় আয়। আবার কোম্পানির আয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় সূচকের প্রবৃদ্ধি ছিল বেশি। ফলে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির পর ২০১০ সালের শেষভাগে এসে বাজারে ধস নামে। ওই ধসের পর কয়েক বছর কোম্পানির আয় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সূচকের উত্থানও কমতে থাকে। ২০১৪ সালে এসে বাজারে কোম্পানিগুলোর আয় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। ওই বছর ঢাকার বাজারের সূচকটিরও ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। আবার ২০১৭ সালে এসে মাত্র ৩ শতাংশ আয় প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বাজারে সূচকের প্রবৃদ্ধি হয় ২৪ শতাংশ। ফলে ২০১৮ ও ২০১৯ সালজুড়ে সূচকের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক।

এ তো গেল সার্বিক বাজারের চিত্র। কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও মৌলভিত্তি বড় নিয়ামক। গ্রামীণফোনের কথাই ধরা যাক। ২০১০ সালে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এসে এ মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির মুনাফায় ২২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তার বিপরীতে একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। একই ভাবে বহুজাতিক অপর কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২১ শতাংশ। তার বিপরীতে শেয়ারের দামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সোয়া তিন শ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ভালো মুনাফায় শেয়ারের ভালো মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। তবে সেই মুনাফা হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য। আর কোম্পানি হতে হবে ভালো, যেখানে থাকবে সুশাসন, থাকবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা।

শেষ করছি পিটার লিঞ্চের একটি পরামর্শ দিয়ে। তিনি বলেছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সফল হতে হলে স্টকে নয়, মনোযোগ দিতে হবে কোম্পানিতে। তাই কী কিনছেন, কেন কিনছেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজুন। যদি নিজেই নিজের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর পান, তবেই সিদ্ধান্ত নিন। অন্যের কথায় বিনিয়োগ করে নিজের পকেট খালি করবেন না।