পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা বন্দর প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পার হয়েছে। কিন্তু টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরুই হয়নি। গত মাসে কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের রাবনাবাদ চ্যানেলের তীরে গিয়ে কোনো নির্মাণকাজের চিহ্ন দেখা যায়নি। তীর রক্ষা বাঁধের পাশে জেগে ওঠা গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নদীর তীরের অদূরে রাবনাবাদ চ্যানেলে ভাসছে জাহাজ বেঁধে রাখার জন্য মুরিং বয়া।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০১৮ সালের মধ্যে সেখানে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করে বন্দর চালুর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। গত ১৮ নভেম্বর সড়কপথে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নে আন্ধারমানিক নদীর তীরে প্রশাসনিক ভবন, গুদাম, পানি শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। পন্টুন দেখা গেছে নদীর তীরে। বন্দরের কাজে ব্যবহারের নিজস্ব জলযান রাখার জন্য একটি সার্ভিস জেটিও নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কোনো স্থাপনা নেই। সেখানে পাওয়া গেল সার্ভিস জেটি নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ফোরম্যান আরব আলীকে। তিনি জানালেন, বন্দরের জাহাজ রাখার জন্যই এই জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। কাজ শেষের দিকে। মূল বন্দরে যেতে হলে আন্ধারমানিক নদী পেরিয়ে লালুয়া ইউনিয়নে যেতে হবে।
আরব আলীর কথামতো সার্ভিস জেটির অদূরে নৌকায় আন্ধারমানিক নদী পার হয়ে মোটরসাইকেলে আধা ঘণ্টা পথ পাড়ি দেওয়ার পর দেখা মেলে টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাবিত জায়গা। স্থানীয় বোট মালিক হাবিব হাওলাদার জানালেন, বন্দর নির্মাণের জন্য এখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাঁরা ক্ষতিপূরণও পেয়েছেন। তবে বন্দরের কাজ শুরু হয়নি।
পাঁচ বছরেও মূল বন্দরের কোনো অবকাঠামো হলো না কেন—জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, মূল বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণ ও খননকাজের প্রক্রিয়াগত কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মূল নির্মাণকাজ শুরু হলে ২০২১ সালের মধ্যে পায়রা বন্দরে টার্মিনাল চালু হবে।
পায়রা বন্দরে কী দরকার ও কী হয়নি
সমুদ্রগামী কোনো জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর জন্য প্রথমে দরকার হয় জাহাজ চলাচলের নৌপথ। সাগর থেকে যে পথে বন্দরের মূল জেটিতে পণ্য খালাসের জন্য জাহাজ আনা হবে, সেই পথ আগে তৈরি করতে হবে। তবে পায়রা বন্দরের প্রস্তাবিত টার্মিনালে ঢোকার মুখে ৬৫ কিলোমিটার নৌপথ এখনো খনন করা হয়নি।
নৌপথ প্রস্তুত হওয়ার পর দরকার হয় সেই নৌপথ পেরিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য নদীর তীরে জেটি। পায়রায় এখনো কোনো জেটি হয়নি। জেটিতে ভেড়ানোর পর দরকার হয় জাহাজ থেকে কনটেইনার বা পণ্য ওঠানো-নামানোর যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতিও সংযোজন হয়নি। আবার পণ্য নামানো হলে বা রপ্তানি পণ্য জাহাজে তুলে দেওয়ার জন্য টার্মিনাল থেকে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত সড়ক বা রেল যোগাযোগ দরকার হয়। এটিও এখনো হয়নি।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচ বছরে অনেক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এই সময়ে টার্মিনাল নির্মাণের মূল কাজে হাত দেওয়া হয়নি। যেসব অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে, তাতে বন্দরের পণ্য ওঠানো-নামানোর সুযোগ নেই। ফলে প্রথম লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পায়রা বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণ হয়নি।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, টার্মিনাল নির্মাণের মূল কাজের অনুমোদন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পাঁচ বছর পর। গত ৪ নভেম্বর লালুয়া ইউনিয়নের বানাতিপাড়ায় ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকায় একটি মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণের প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন হয়েছে। ২০২১ সালে এই টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। প্রায় ৬৫০ মিটার লম্বা টার্মিনালে তিনটি জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। এই টার্মিনালে ৩ লাখ ৬০ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সুবিধা থাকবে।
জানতে চাইলে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এম জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি অর্থায়নে প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন ছয় মাসের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হলে নির্মাণকাজ শুরু হবে। পাশাপাশি আরও দুটি টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন-প্রক্রিয়া গুছিয়ে আনা হয়েছে। বিদেশি অর্থায়নে নদী খনন প্রকল্পের চুক্তি হবে শিগগিরই। ২০২১ সালে তিনটি টার্মিনাল ও নদী খননকাজ শেষ করে এই বন্দর চালু হবে। এসব জেটিতে ভেড়ানো যাবে ১২ মিটার গভীরতার জাহাজ।
পায়রা বন্দরের এমন অগ্রগতিতে ব্যবসায়ীরা কী ভাবছেন—জানতে চাইলে পটুয়াখালী চেম্বারের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে রাবনাবাদ চ্যানেলের গভীরতা। এই গভীরতা বাড়ানো ছাড়া এখানে বড় জাহাজ ভেড়ানো যাবে না। তবে টার্মিনাল নির্মাণ না হলেও সড়কসহ নানা অবকাঠামোর উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে।
যেভাবে এল পায়রা
পায়রা বন্দর নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। ২০১০ সালে সংসদীয় কমিটির ১৪৩তম বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রাথমিক সমীক্ষা করে প্রতিবেদন উপস্থাপনের সুপারিশ করা হয়। তিন দিন ঘুরে ছয় সদস্যের কমিটি ২০১০ সালের ৩ আগস্ট প্রতিবেদন দেয়।