সব সরকারের বৈধতার প্রয়োজন হয়, সে তারা যত শক্তিশালী হোক না কেন। দেখা গেছে, বিশ্বের অনেক দেশের সরকার কার্যত অকেজো হয়ে গেলেও নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করতে চায়।
সে জন্য দেখা যায়, গত ২০ বছরে আফ্রিকার দেশগুলোতে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। সেখানকার সব দেশেই যে গণতান্ত্রিক সরকার আছে, তা নয়। আবার কোনো দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী, কোনো দেশের দুর্বল, কিন্তু সব সরকার নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত করতে জনগণের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জাহিদ হোসেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন, বিভিন্ন ধরনের সরকারব্যবস্থার মধ্যে থেকেও দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করা যায়, এমন নয় যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই সব হতে হবে।’
জবাবে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, খানিকটা বৈধতা সব সরকারেরই দরকার। বৈধতা না থাকলে বেশি দিন সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হয় না। কাজাখস্তানে এখন ঠিক তা–ই হচ্ছে। বিষয়টি হলো, গণতন্ত্রে একধরনের জবাবদিহি আছে, সে জন্য সরকারকে করে দেখাতে হয়। আবার জনগণ বলতে পারে, কিছু না করলে ভোট দেব না।’
ভারতীয় উপমহাদেশে সবকিছুর অতিকেন্দ্রীভূত হয়েছে। এটা বড় সমস্যা বলেই মনে করেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের উত্তর প্রদেশে ২০ কোটি মানুষ। তাঁরা বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দেবেন। যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁদের পক্ষে কিন্তু ২০ কোটি মানুষের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। তবে এই রাজ্যের জনসংখ্যা যদি ১০ হাজার হতো, তাহলে নির্বাচিত নেতাদের পক্ষে বলা সম্ভব হতো না, অনেক চেষ্টা করেও কিছু করা গেল না।
এই পর্যায়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘জবাবদিহি কি তাহলে প্রধান শর্ত?’ জবাবে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সেটা বলব না, তবে জবাবদিহি ছাড়া এগোনো কঠিন।’
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত নীতিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা যায় কীভাবে, তা নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন। সারা জীবন তিনি এসব নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
জাহিদ হোসেন প্রশ্ন করেন, এভাবে নীতিগত কারিগরির মাধ্যমে কি দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। জবাবে অভিজিৎ বলেন, ‘অনেক কিছু পৃথিবীতে ঘটছে, যার ওপর আমাদের, অর্থাৎ অর্থনীতিবিদদের হাত নেই। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে হিসাব করে দেখা যায়, সেখানে হয়তো নীতির কিছু ভূমিকা আছে। কিন্তু শুধু নীতি দিয়ে প্রবৃদ্ধির খুব বেশি উনিশ-বিশ করা যায় না। মূল বিষয় হলো, যেসব ব্যাপারে আমাদের হাত নেই, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। যেখানে সুযোগ আছে, সেখানে হাত দেওয়া উচিত।’
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে নীতি প্রণয়ন করতে দেওয়া হলে আপনি সার্বিকভাবে কোন কাজটি করতেন?’
জবাবে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কাদের জন্য কর্মসূচি নেওয়া হবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। হতদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচি করতে হলে এক রকম, আবার যাদের সামান্য কিছু আছে, তাদের জন্য আরেক রকম। তখন ভাবতে হবে, এরা আরেকটু এগোতে পারছে না কেন। সে জন্য কারা ব্যবসা করতে পারবে, তাদের চিহ্নিত করে সহায়তা করা যায়।
দারিদ্র্য বিমোচনে রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রসঙ্গে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে অবান্তর বিষয় নিয়ে টানাটানি হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা জনগণকে ভাঁওতা দিচ্ছে। তারা বোঝাচ্ছে, মাস্ক না পরাই সবচেয়ে বড় সফলতা, কিন্তু তাতে মৃত্যু হলেও কিছু আসে যায় না।’ তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রের নিজস্ব যুক্তিকাঠামো আছে, তা কেন কাজ করে না, সেই প্রশ্নের উত্তর আজও তিনি খুঁজছেন।