দেশে খাওয়ার লবণ আমদানি নিষিদ্ধ। কিন্তু বাজারে চাহিদা বেশি, মৌসুম শুরুর আগে দামও ব্যাপক চড়া ছিল। ফলে হঠাৎ করেই শিল্প খাতে লবণ আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বিপরীতে বাজারে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর কাছাকাছি নকশা, রং ও নামের মোড়কে লবণ বিক্রি বাড়ছে।
দেশের লবণ পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, শিল্পের নামে খাওয়ার লবণ আমদানি করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এই লবণ আসছে সরাসরি পরিশোধিত অবস্থায়। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশে পরিশোধনের ব্যবস্থা ছাড়াই শিল্পকারখানার নামে লবণ এনে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করতে পারছেন। তাঁদের আয়োডিনও মেশাতে হচ্ছে না। এতে এক দিকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে চাষিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বাজারে সুপরিচিত ব্র্যান্ডগুলো এই বিদেশি লবণের কাছে টিকতে পারছে না। কারণ, বিদেশি লবণে খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ অনেক বেশি দেওয়া হচ্ছে। আবার এসব লবণের দামও কম। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ রোববার লবণ নিয়ে এক বৈঠক ডেকেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, শিল্প ও খাওয়ার মিলিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে লবণ আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার টন। পরের বছর তা বেড়ে ১০ লাখ ৯০ হাজার টনে উন্নীত হয়। যদিও এর মধ্যে আমদানির অনুমতি দেওয়া আড়াই লাখ টন লবণ রয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৪ লাখ ৪০ হাজার টন লবণ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার টন আমদানির অনুমতি পাওয়া। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ৫ লাখ টনের অনুমতি দেওয়া হলেও দেশে এসেছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার টন। এর আগে ২০১৫ সালে ১ লাখ টন আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
মোট আমদানি থেকে অনুমতি পাওয়া পরিমাণটুকু বাদ দিলে বাকিটা শিল্প খাতের লবণ হওয়ার কথা। দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিল্প খাতে ৪ লাখ ৬৬ হাজার টন লবণ এসেছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে ৯ লাখ ৬০ হাজার টনে উন্নীত হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর বড় অংশ খাওয়ার লবণ, যা শিল্প লবণ নামে আমদানি করে বাজারে ছাড়া হয়েছে।
মোল্লা সল্টের মহাব্যবস্থাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে নানাভাবে পণ্য বাজারে আসবেই। বিদেশি লবণ বাজারে আসার কারণে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু আমাদের ব্র্যান্ড নামেই ১১টি ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উৎপাদনের হিসাব ও আমদানির পরিসংখ্যান হিসাব করলে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মোট ২৯ লাখ ৩০ হাজার টন লবণের সরবরাহ ছিল। ওই বছর দেশে ১৪ লাখ ৯২ হাজার টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল। এ বিপুল লবণ সরবরাহ হলেও বিসিক চাহিদার হিসাব ধরেছিল ১৬ লাখ ৫৭ হাজার টন।
শিল্প লবণে শুল্ক কম
শিল্প খাতে লবণ আমদানিতে মোট করভার ৩৭ শতাংশের মতো। অন্যদিকে খাওয়ার লবণ আমদানির মোট করভার ৮৯ শতাংশ। ফলে শিল্প লবণ আমদানি করাই লাভজনক। একটি কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, পরিশোধিত অবস্থায় এক কেজি শিল্প লবণ আমদানির খরচ ১২ টাকা। স্থানীয় পরিশোধিত লবণের দাম ২৫ টাকার মতো।
লবণ নিয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন গত ডিসেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে দেশে লবণের দাম বেশি হওয়ায় সোডিয়াম সালফেটের (শিল্প লবণ) নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাওয়ার লবণ) আমদানি হচ্ছে। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে আমদানি করা লবণের দাম কৃষকের উৎপাদন খরচের চেয়ে যাতে বেশি হয়, সেই হারে শুল্ক আরোপ করে আমদানি উন্মুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে প্রতি কেজি লবণের উৎপাদন খরচ হিসাব করা হয়েছে ৬ টাকা। আমদানি করলে প্রতি কেজির ব্যয় ৫ টাকা ৭০ পয়সা দাঁড়ায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা ১০ টাকা
এক কেজি লবণে এখন খুচরা বিক্রেতাদের মুনাফা ১০ টাকা। বিভিন্ন সুপরিচিত ব্র্যান্ড দোকানমালিকদের কাছে সেরা মানের লবণ প্রতি কেজি ২৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। কিন্তু এর মোড়কে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা। ফলে দেশে মৌসুমের কারণে লবণের দাম কমলেও ক্রেতারা এর সুফল পাচ্ছেন না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশি লবণে খুচরা ব্যবসায়ীদের বাড়তি কমিশন দেওয়া হয়। দেশীয় কোম্পানিগুলো সেটা না দিলে খুচরা বিক্রেতারা লবণ বিক্রি করতে চান না। লবণ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা বলেন, অনেকবার শিল্প মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয় না।