রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ছয় মাস আগেই নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাবনার পাকশীতে অবস্থিত এই কাগজকলের ১০০ দশমিক ৫১ একর জমি রয়েছে। নিরাপত্তা ও ভৌত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুরো জমিই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য লাগবে বলে সরকার মনে করছে। সে অনুযায়ী জমির প্রতীকী মূল্য ধরা হচ্ছে ১ হাজার ১ টাকা।
বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কয়েক মাস ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায়। আর পেপার মিলটি হচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) অধীন। বিসিআইসি জমির বদলে টাকা দাবি করার কারণেই জটিলতা ।
শুরুতে মিলের পুরো জমি সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে চেয়েছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। পরে সেখান থেকে সরে এসে গত এপ্রিলে প্রতীকী মূল্যে জমি পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। বলা হয়, সাশ্রয়ী মূল্যেও জমি কেনার টাকা তাদের নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা যেহেতু রাষ্ট্রের অন্যতম অগ্রাধিকার, তাই প্রতীকী মূল্যে এ জমি পাওয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী ১৫ মে ওই সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেন।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর ২০ জুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে বিসিআইসি জানিয়েছে, পেপার মিলটির দায়দেনা রয়েছে ৪৭৫ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এর পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৪২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০০২ সালে পে-অফ করা জনবলের মধ্যে আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০৭ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছেন। এতে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আরও ৩৭৭ জনকে পুনর্বহালের বিষয়ে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। এ জন্য দরকার আরও ৫০ কোটি টাকা।
বিসিআইসি আরও জানায়, মোট ৫৮৪ জনের (২০৭+৩৭৭) পেনশন ও গ্র্যাচুইটি বাবদ খরচ হবে ১০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দায়দেনা, লোকসান ও জনবলজনিত ব্যয়ের কারণে নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের এখন দরকার ১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। তাই ১০১ দশমিক ৫১ একর জমি এবং এর ওপর সব স্থাপনার মূল্য বাবদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে বিসিআইসি ১ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা দাবি করেছে।
জমি বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে ২৩ জুন শিল্পসচিব বরাবর চিঠি দেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। একই মন্ত্রণালয় পরে গত ১০ অক্টোবর অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী পেপার মিলটির ১০১ দশমিক ৫১ একর জমি ১ হাজার ১ টাকা প্রতীকী মূল্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধান করছে। এ কাজে তাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা, সদস্যদের আবাসনব্যবস্থাসহ অন্যান্য কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে জমিটি প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটির দায়দেনার বিষয়টিও নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।’
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ৪ নভেম্বর মিলটির দায়দেনা নিরূপণসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে ছয় সদস্যের একটি কমিটি করেছে। অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে এই বিভাগের আরও দুজন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির একজন করে প্রতিনিধি রয়েছেন। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কমিটির কাজ শেষের দিকে।
পদ্মা নদীর তীরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে ১৯৭০ সালে স্থাপিত হয় নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল। মাসে ১৫ হাজার টন কাগজ উৎপাদন ক্ষমতার এই কল যাত্রা শুরু করে ১৯৭৫ সালে। তবে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন সরকার এটি বন্ধ করে দেয়, যা এখন পর্যন্ত বন্ধ।
বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলতে গতকাল বুধবার শিল্পসচিব আবদুল হালিম এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসচিব আনোয়ার হোসেনকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। বিষয়বস্তু উল্লেখ করে উভয়ের মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তাঁরা সাড়া দেননি।
জানতে চাইলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র পেপার মিলের জমিতে হবে না। এখানে নিরাপত্তা ও ভৌত সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এ জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।