বিশেষায়িত জাহাজ

রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি

>
বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা আছে। পণ্যবাহী সাধারণ জাহাজের তুলনায় এসব বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানি করলে দামও বাড়তি পাওয়া যায়। তাই এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে। ছবি: সৌরভ দাশ
বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা আছে। পণ্যবাহী সাধারণ জাহাজের তুলনায় এসব বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানি করলে দামও বাড়তি পাওয়া যায়। তাই এ ব্যাপারে  উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে।  ছবি: সৌরভ দাশ
  • উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানি করে বেশি আয় করা সম্ভব
  • বিশেষায়িত জাহাজে মূল্য সংযোজনও বেশি হয়
  • দরকার উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত ছোট-বড় জাহাজ

সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোর দিচ্ছে বিশ্বের উপকূলীয় দেশগুলো। সমুদ্র থেকে মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক পর্যটন, সমুদ্র নিরাপত্তা ও গবেষণা ঘিরে বাড়ছে এসব কর্মকাণ্ড। সমুদ্র অর্থনীতির এসব কর্মকাণ্ডের জন্য দরকার উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত ছোট-বড় জাহাজ। পণ্যবাহী জাহাজ রপ্তানির বাজারের মতো উত্থান-পতন নেই উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত ছোট জাহাজের রপ্তানির বাজারে। তাই সম্ভাবনাময় এই রপ্তানির বাজার ঘিরেই আগ্রহ বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর।

প্রায় ১১ বছর আগে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জাহাজ রপ্তানি খাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১২ সালে বৈশ্বিক মন্দার পর এ খাতে উত্থান-পতনের কারণে দেশীয় জাহাজ নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ রপ্তানির উত্থান-পতনের বাজারে ঝুঁকি নিতে চান না এখন দেশীয় উদ্যোক্তারা। বরং তাঁরা সম্ভাবনাময় স্থিতিশীল রপ্তানির বাজার ধরতেই বেশি আগ্রহী। এ ছাড়া বিশেষায়িত জাহাজে মূল্য সংযোজনও বেশি হয়।

এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ কারখানাগুলো সর্বোচ্চ ১০ হাজার টন পণ্য ধারণক্ষমতার জাহাজ নির্মাণে সক্ষম। বৈশ্বিক বাজারে এই ধারণক্ষমতার জাহাজগুলোকে সাধারণত ছোট আকারের জাহাজ হিসেবে ধরা হয়। তাই দেশীয় কারখানাগুলো তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ নির্মাণ করেও রপ্তানি মূল্য বেশি পাবে না। এ কারণে এই বাজারে বাংলাদেশের নির্মাতাদের খুব ভালো করার সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে ছোট আকারের উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজের রপ্তানি মূল্য অনেক বেশি। দাম বেশি হওয়ায় মুনাফার ভাগও বেশি, তাই বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানির বাজারে নিজেদের অংশীদারত্ব বাড়াতে চান এ দেশের জাহাজ নির্মাতারা।

জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বেশি। অন্তত ১০টি জাহাজ নির্মাণপ্রতিষ্ঠান যদি রপ্তানিতে যুক্ত হয়, তাহলে বছরে এই খাতে ২ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার বা ২০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব। এ জন্য এই খাতের উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার।

জাহাজ নির্মাণশিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাজ রপ্তানির যাত্রা শুরুর এক দশকের মাথায় ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো কেনিয়ায় একটি উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানি করে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। গত এক বছরে জাহাজ নির্মাণশিল্পে নতুন যেসব রপ্তানি আদেশ আসছে, সেগুলোর বেশির ভাগই বিশেষায়িত জাহাজের। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জাহাজ রপ্তানি থেকে আয়ের সিংহভাগই আসবে উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ থেকে।

রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এইওএসআইবি) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশীয় জাহাজ নির্মাতাদের হাতে তিনটি উচ্চ প্রযুক্তির ট্রলার (গভীর সাগরে মাছ আহরণের জাহাজ), দুটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি পরিবহনকারী জাহাজ, একটি অফশোর পেট্রল ভেসেল ও দুটি বিশেষায়িত ট্যাংকার নির্মাণের কার্যাদেশ রয়েছে। বিশেষায়িত এসব জাহাজের ১০টির রপ্তানি মূল্য প্রায় ৯৮০ কোটি টাকা। রপ্তানি বাজার ছাড়াও দেশের ভেতরে সাগরে ও নদীপথে ব্যবহারের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণ শুরু করেছেন দেশীয় নির্মাতারা।

এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তবে রপ্তানি করতে সক্ষম এমন কারখানা আছে দেশে ১০টি। এর মধ্যে দেশে ব্যবহারের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণ করে ইতিমধ্যে দক্ষতা দেখিয়েছে বেশ কয়েকটি কারখানা। দেশের জন্য তৈরি করা হলেও এসব জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হয়েছে কারখানাগুলোকে। ফলে কারখানাগুলোর একই ধরনের জাহাজ রপ্তানির সক্ষমতা আছে। যেমন গত শতকের আশির দশকে হাইস্পিড শিপ বিল্ডিং কারখানা চারটি বিশেষায়িত মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণ করেছে। এরপর ওয়েস্টার্ন মেরিন ও এফএমসি শিপইয়ার্ডও মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে। প্রথমে দেশে ব্যবহারের জন্য জাহাজ নির্মাণ করে পরে রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছেন জাহাজ নির্মাতারা। এ ছাড়া কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে তিনটি কারখানায় খননকারী জাহাজ (ড্রেজার) নির্মাণ করেছে। এখন একসঙ্গে ২০টি খননকারী জাহাজ নির্মাণের কাজ চলছে বলে শিপইয়ার্ডটির কর্মকর্তারা জানান। বেসরকারি খাত ছাড়াও নৌবাহিনী পরিচালিত তিনটি ইয়ার্ডও নিজেদের ব্যবহারের জন্য যুদ্ধজাহাজসহ বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে।  

আবার দেশে উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজ ‘এলপিজি ক্যারিয়ার’ নির্মাণ করেছে রেডিয়েন্ট শিপইয়ার্ড লিমিটেড। তিনটি জাহাজ নির্মাণ করে হস্তান্তরও করেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দাউদপুরের এই জাহাজ নির্মাণ কারখানাটি। পাশাপাশি আরও চারটি নির্মাণের কাজ চলছে। ফিশিং ট্রলারসহ আরও কয়েক ধরনের বিশেষায়িত জাহাজ তৈরি করেছে এই শিপইয়ার্ড। আগে এসব জাহাজ বিদেশ থেকে আমদানি হতো। তাতে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যেত। এখন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। আবার রপ্তানির বাজারে পদার্পণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কারণ দেশে হোক বা বিদেশে রপ্তানির জন্য হোক, এসব জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক গ্যাস কোড ও আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়।

রেডিয়েন্ট শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে তাঁদের শিপইয়ার্ডই নদীপথে চলাচলের উপযোগী এলপিজি পরিবহনকারী বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণ করেছে। এ ধরনের বিশেষায়িত জাহাজ রপ্তানির জন্য এখন তাঁরা বিশ্বের কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করছেন।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, জাহাজ নির্মাণ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন, কোরিয়া ও জাপান। বিশ্বের মোট জাহাজ নির্মাণের ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ হয় এই তিনটি দেশে। এই তিন দেশ আবার বড় আকারের পণ্যবাহী ও উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণ করে, যেখানে বাংলাদেশের সক্ষমতা নেই। তবে উচ্চ প্রযুক্তির ছোট আকারের জাহাজ নির্মাণে এসব দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুযোগ আছে।

কারণ হিসেবে এ দেশের উদ্যোক্তারা বলেন, জাহাজ নির্মাণে নেতৃত্ব দেওয়া দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমমূল্য কম। আবার একটি জাহাজ নির্মাণে আনুষঙ্গিক আয়োজনেও খরচ কম পড়ে। সব মিলিয়ে অন্য দেশের চেয়ে ১০ শতাংশ কমে প্রতিযোগিতামূলক দর দিতে পারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে ছোট আকারের বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে যাচ্ছে দেশীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।