পণ্য রপ্তানিতে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে ৪১৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ। সেই রেকর্ড পরের মাসেই, অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত অক্টোবরেই ভেঙে গেছে। এই মাসে ৪৭২ কোটি ডলার বা ৪০ হাজার ৫৯২ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানির নতুন রেকর্ড হয়েছে।
এই রেকর্ড পরিমাণ পণ্য রপ্তানির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। গত মাসে ৩৫৬ কোটি ডলার বা ৩০ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এটিই পোশাক খাতের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানির রেকর্ড। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরেই হয়েছিল সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানির রেকর্ড। তখন রপ্তানি হয়েছিল ৩৪২ কোটি ডলারের পোশাক।
অক্টোবরে রেকর্ড পরিমাণ পণ্য রপ্তানির কারণে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার। এই আয় আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য।
সুতা থেকে শুরু করে সরঞ্জামের দাম ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সেটি আমলে নিলে রপ্তানি প্রকৃতপক্ষে বেড়েছে ৭-৮ শতাংশের মতো। তারপরও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যা হয়েছে, সেটি দুর্দান্ত।ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল মঙ্গলবার রপ্তানি আয়ের এই হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল ও রাসায়নিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। বড় খাতের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে মোট পণ্য রপ্তানির ৮০ শতাংশই পোশাক খাত থেকে এসেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২৬২ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৮ হাজার ৫৩২ কোটি টাকার। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ১ হাজার ৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা বলছেন, ক্রেতা দেশগুলোতে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। আবার বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি যা-ই থাকুক না কেন, পোশাক কারখানায় তার প্রভাব পড়েনি। সে কারণে ক্রেতারা এ দেশের ওপর আস্থা রেখেছে। তা ছাড়া প্রধান প্রতিযোগী দেশ চীনে পোশাক তৈরির ব্যয় বাড়ছিল। সম্প্রতি জ্বালানিসংকটের কারণে তারা সমস্যায় পড়েছে। ভিয়েতনামেও করোনার বিধিনিষেধে লম্বা সময় কারখানা বন্ধ ছিল। সে জন্য দেশ দুটি থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হয়ে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে এসেছে।
আবার তৈরি পোশাকের মধ্যে নিটের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি। জুলাই-অক্টোবর—চার মাসে ৭২০ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৪১ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সামনের তিন-চার মাসেও পোশাক রপ্তানিতে উচ্চ ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা বেশি দেখাচ্ছে। সুতা থেকে শুরু করে সরঞ্জামের দাম ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সেটি আমলে নিলে রপ্তানি প্রকৃতপক্ষে বেড়েছে ৭-৮ শতাংশের মতো। তারপরও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যা হয়েছে, সেটি দুর্দান্ত।
ফজলুল হক আরও বলেন, কাঁচামালের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই অনুপাতে পোশাকের দাম বাড়ায়নি ক্রেতারা। কারখানামালিকদের দক্ষতার সঙ্গে দর-কষাকষি না করলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
এদিকে রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। আলোচ্য চার মাসে ৪৬ কোটি টাকার প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। রপ্তানিতে তৃতীয় স্থানে আছে হোম টেক্সটাইল। এই খাতের রপ্তানির পরিমাণ ৪১ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৬ কোটি ডলারের। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। অবশ্য পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে ২৪ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ৩৩ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রপ্তানি বাজারে নতুন যে ক্রেতারা আসছে এবং তারা কোন ধরনের পণ্য কিনছে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তাহলেই বর্ধিত রপ্তানি আয়ের প্রবণতা ধরে রাখার কাজটা কিছুটা হলেও সহজ হবে।