বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলো ছোটবেলা থেকেই খুব টানে। এমন এক জগতে চলে গেছে বিশ্ব, যেখানে সব হচ্ছে অটোমেটিক মেশিনে, এমনকি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ক্যাপসুল, মেটাচ্ছি ক্ষুধা—এসব গল্প পড়ে চমৎকৃত হয়েছি। মজার বিষয় হচ্ছে, বড় হতে হতে একসময় কল্পকাহিনিগুলোর অনেক কিছুই আমাদের জীবনের সঙ্গে মিলতে শুরু করে। কম্পিউটার থেকে সুপার কম্পিউটারে হচ্ছে কাজ, নানা ভিটামিনের ক্যাপসুল ক্ষুধা না মেটালেও দিচ্ছে পুষ্টি। একটু ঘুরিয়ে বললে হয়, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্ব যেন অনেকটাই সেই কল্পকাহিনির যুগে চলে গেছে। আগে ‘ভবিষ্যতের কাজ’ শব্দটা শুনলে কেমন যেন একটা বায়ুমণ্ডলীয় বৈজ্ঞানিক আবহ চোখের সামনে ভাসলেও বর্তমান বাস্তবতায় অভূতপূর্ব নানা বিষয় নতুন স্বাভাবিকে রূপ নিচ্ছে।
এই তো কদিন আগেও বাসায় বসে অফিসের কাজ করা যায়, বিষয়টি অবাস্তব মনে হলেও নতুন প্রেক্ষাপটে তা একরকম আয়ত্ত করে ফেলেছে মানুষ। তাও আবার একেবারে অল্প সময়ে। ওয়েবে ওয়েবে চলছে সেমিনার, আলোচনা, জরুরি বৈঠক। এমন যে হবে, কিছুদিন আগেও ভাবেনি মানুষ। তবে কল্পকাহিনির চেয়ে এখানে একটি বিষয় আলাদা। তা হলো, মানুষের হাতে একটা বিকল্প রয়েছে সে এই পরিবর্তন গ্রহণ করবে কি করবে না। আর এই পরিবর্তন গ্রহণ করা বা না করার যে প্যারাডক্স তৈরি হয়েছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে শ্রমশক্তির জন্য এক মারাত্মক ঝুঁকির। শুনতে যেমন জটিল মনে হচ্ছে, ঝুঁকির এই বাস্তবতাটাও কিছুটা তেমনই।
আমাদের বর্তমান পৃথিবীর এই কল্পকাহিনিতে রয়েছে করোনাভাইরাস, যা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছেছে। যা ঠেকাতে অনেক অঞ্চলেই ঘরবন্দী জীবন বেছে নিতে হচ্ছে মানুষকে। কিন্তু ঘরে বসে হাত গুটিয়ে রাখার কোনো সুযোগই নেই এই যুগে। মানুষকে জীবনের জন্যই জীবিকা চালিয়ে যেতে হয়। তাই এই মহামারি ত্বরান্বিত করেছে ডিজিটাল পরিবর্তনকে দ্রুত গ্রহণ করতে। মানুষে মানুষে যোগাযোগে, কাজে, শিক্ষায় এখন ভার্চ্যুয়াল উপায় বেছে নিতে হচ্ছে। প্রযুক্তিগবেষক গার্টনার ডিজিটাল দক্ষতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও ভালো ফলাফলের জন্য প্রযুক্তি থেকে সেরাটা তুলে নেওয়ার ক্ষমতা হিসেবে। এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে কেবল বর্তমান সময়।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বর্তমান বিশ্বের জন্য এই ভার্চ্যুয়াল বাস্তবতার নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, নতুন এই পরিবর্তন এখন বাস্তবতা হলেও সবার জন্য এটি মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন। বিষয়টি একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া যায়। নতুন সাধারণের জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করা বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ডিজিটাল শিক্ষা। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে মাত্র ৩২ শতাংশ মানুষের মৌলিক ডিজিটাল শিক্ষা রয়েছে। অর্থাৎ মেইল পাঠানো, ইউটিউবে ভিডিও দেখা এই ধরনের শিক্ষা। এমনকি উচ্চ আয়ের দেশে এই হার ৬২ শতাংশ, আর মানসম্মত ডিজিটাল শিক্ষা রয়েছে মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষের। আমরা দেখেছি এই মহামারির সময় কীভাবে কাজ হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। আবার একই সময়ে মাইক্রোসফটের অনুমান বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন ডিজিটাল দক্ষতার চাহিদা আগের চেয়ে বহুগুণ বাড়বে। লকডাউন ডিজিটালাইজেশনকে ত্বরান্বিত করছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আসলে প্রতিটি সংকটের ক্ষেত্রেই দেখা যায় গতানুগতিক পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো হারিয়ে যায়, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন নতুন চাকরির উদ্ভব হয়। আর কোভিড-১৯ এই ট্রেন্ড ভালোই ধরে রেখেছে।
নতুন বাস্তবতার যে ঝুঁকি
করোনা সংকট কোটি কোটি মানুষকে অনলাইনে অংশ নিতে সক্ষম করেছে, তবে যাঁরা সংযুক্ত হতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়িয়েছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হলে, নতুন এই ভবিষ্যতে বিদ্যমান বৈষম্য আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করতে প্রস্তুত না অনেক কর্মী ও ব্যবসায়ী। তাই নতুন সুযোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে অসুবিধার মুখোমুখি হবেন তাঁরা। অন্যদিকে দক্ষ যাঁরা, তাঁদের মানিয়ে নেওয়া অনেক সহজ হবে। স্বল্পোন্নত অর্থনীতিগুলো সবচেয়ে বেশি লড়াই করবে এবং বেকারত্বের হার বেশি হবে, পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক থাকতেও অসুবিধায় পড়বে। তবে এর পরও একটি উত্থান, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ফলাফলের অবকাশ রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিশ্লেষক তিনটি বিষয়ের কথা বলেছেন। এক. সংস্থাগুলোকে বুঝতে হবে বিভিন্ন বিভাগে জ্ঞানভিত্তিক বিনিয়োগ তাদের আরও লাভজনক করে তুলবে। দুই. ভার্চ্যুয়াল কাজ করা কর্মী যেখানেই থাকুন না কেন, ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের সুবিধা দিতে হবে। যেমন ব্যবসায়গুলোকে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিভা সংগ্রহ করতে হবে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনার প্রচার হবে, নতুন ধারণা সঞ্চারিত করবে। গ্রামীণ অঞ্চলে যে থাকবে, তাকে এ জন্য এলাকা ছাড়তে হবে না। নিজ এলাকা থেকেই তা সে করতে পারবে। তিন. এই ভার্চ্যুয়াল বিশ্বে মানুষ আরও বেশি করে জীবন ও কর্মে ভারসাম্য আনতে পারবে। শেখার প্ল্যাটফর্ম বিস্তৃত হবে, নেটওয়ার্কিং এবং দক্ষতা ভাগ করে নেওয়ার আরও সুযোগ আগের চেয়ে বেশি হবে।
ঝুঁকি কমাতে ভূমিকা থাকবে যাদের
এই নতুন কল্পযুগকে বাস্তব করতে তিনটি চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এক. করপোরেশন, দুই. ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) এবং তিন. একক ব্যক্তি। আর তিন চরিত্রকে সহায়তা করবে সরকার। করপোরেশন ভূমিকা রাখতে পারে তার কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তুলে। এমন একটি সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা জরুরি, যেখানে যোগাযোগমাধ্যম শক্তিশালী হয়ে উঠবে, জ্ঞান বৃদ্ধির মানসিকতা এবং পুরস্কারের জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়। সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হবে তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেওয়া। এর মাধ্যমে তারা কার্যকরভাবে ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার করা শিখতে এবং ব্যাখ্যা করতে পারবে। মানুষ যখন বুঝতে পারবে, তাদের নিজস্ব কাজ বিকশিত হচ্ছে, তখন যেখানে তাদের দক্ষতার ব্যবধান রয়েছে, সেগুলো উপলব্ধি করতে পারবে। এবং প্রশিক্ষণ থেকে সেরাটি গ্রহণ করতে পরবে। এসএমইগুলোর ভূমিকা হলো, তাদের এই রূপান্তর মানিয়ে নিতে হবে এবং আলিঙ্গন করতে হবে দ্রুত। সরকার এবং শিল্পকে অবশ্যই তাদের এই ডিজিটাল যাত্রায় সহায়তা করতে হবে।
এবার প্রশ্ন, আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষের ভূমিকা কোথায়? আমাদের ভূমিকা হলো এখন আমাদের নিজেদের নতুন করে সাজাতে হবে। ডিজিটাল সহায়তা পেতে আমাদের চারপাশে পরিক্রমণ করতে হবে। নানাভাবে এখন মানুষ নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। সেটা অনলাইনেও সম্ভব। সেগুলোর প্রতি মনোযোগী হতে পারে। নতুন এই স্বাভাবিককে মেনে নিতে হবে। কারণ, বর্তমান তো আছেই, সেই সঙ্গে কোভিড-পরবর্তী বিশ্বও আরও ডিজিটাল হবে। তাই আরও সংযোগ, ডিজিটাল দক্ষতা ও সাশ্রয়ীকরণ প্রয়োজন।