করোনাকালের ঈদ

যুদ্ধকালীন ঈদের মতো ছিল করোনাকালের প্রথম ঈদ

করোনাকাল বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা গেছে থমকে। উৎসবের আনন্দও ম্লান হয়ে গেছে করোনার থাবায়। তবু ঈদ আসে, আসে উৎসব।

অনেকে বড়বেলায় ঈদের আনন্দ খোঁজেন ফেলে আসা ছোটবেলার ঈদে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দা। তাই শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা সংকটের মধ্যে তৃতীয় ঈদ উদ্‌যাপিত হতে যাচ্ছে কয়েক দিন পর। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, প্রধান নির্বাহী ও ব্যাংকারদের ঈদের একাল-সেকাল নিয়ে এবারের মূল আয়োজন।

ফজলুল হক

আমাদের পৈতৃক বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় হলেও বাবা ব্যবসায়িক সূত্রে নারায়ণগঞ্জে আসেন। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই নারায়ণগঞ্জে। ছোটবেলার ঈদ ছিল দুর্দান্ত। তার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে।

ছোটবেলায় ঈদের জামা বানানো একটা বিশাল ব্যাপার ছিল। পরিচিত টেইলারের দোকানেই জামা বানাতাম। আমার খেয়াল আছে, প্রতিদিনই একবার করে টেইলারের দোকানে গিয়ে খোঁজ নিতাম, জামার কাপড় কাটছে কি না। সেলাই করছে কি না। কবে হাতে পাব। সেই জামা পাওয়ার পর ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের আগে নতুন জামা কাউকে দেখানো যাবে না—এমন একটা ব্যাপার কাজ করত।

আরেক ঘটনা খুব মনে আছে। চাঁদরাতের দিন আমি বাসার টেবিলঘড়িটা নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। কেন ভোর হচ্ছে না—সেই দুশ্চিন্তায় রাতে দুই-তিনবার ঘুম ভেঙে যেত। সেই সময় ঈদের দিনটাতে ছিলাম আমরা স্বাধীন। অন্যান্য সময় বাসা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে কড়া শাসন ছিল। বের হলেও সন্ধ্যার মধ্যে ফেরার নির্দেশ ছিল। কিন্তু ঈদের দিন কোনো জবাবদিহি থাকত না।

আরেকটু বড় হওয়ার পর ঈদের দিন সিনেমা হলে যাওয়াটা কমন ব্যাপার ছিল। আমাদের সময় বিনোদনের বড় মাধ্যম ছিল সিনেমা। ঈদ উপলক্ষে নতুন সিনেমা মুক্তি পেত। তো নারায়ণগঞ্জের সিনেমা হলে দুপুরের শো-তে যেতাম। কোনো কোনো ঈদে বন্ধুরা থাকলেও একাও গিয়েছি। ঈদের দিন সিনেমা হলে প্রচণ্ড ভিড় থাকায় কালোবাজার (ব্ল্যাক) থেকে বেশি দাম টিকিট কিনতে হতো।

বড় বেলার ঈদটা ঘরের মধ্যেই বেশি কাটে আমার। একটু ঘরকুনো মানুষ আমি। সকালে ঈদের নামাজ পড়ে বাসাতেই থাকি। বিকেলে আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে তার আগেই কেউ চলে এলে অনেক সময় পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

আগেই বলেছি, ছোটবেলা থেকেই সিনেমা দেখা আমার একটা নেশা। সেই নেশাটি বর্তমানে বাংলাদেশি নাটক দেখার দিকে ধাবিত হয়েছে। ঈদের সময় বাংলাদেশি চ্যানেলের নাটকগুলো দেখি। কোনো নাটক যেন মিস না হয়, সে রকম একটা চেষ্টা থাকে। যদিও বিষয়টি নিয়ে আমার সহধর্মিণী বেশ হাসাহাসি করেন।

করোনার কারণে গতবারের ঈদটা অনেক কঠিন ছিল। করোনার সংক্রমণ কম থাকলেও আতঙ্ক অনেক বেশি ছিল। সেই তুলনায় চলতি বছর কম আতঙ্কিত। গতবার ভাইবোনেরা ঈদের দিন বাসায় আসেনি। আমরাও কোথাও যাইনি। মোটামুটি যুদ্ধকালীন ঈদের মতো ছিল করোনাকালের প্রথম ঈদ।

গত ১৩ মার্চ আমার মা মারা গেছেন। প্রতি ঈদে সকালে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে মাকে বলে যেতাম, ‘মা নামাজ পড়তে যাই।’ মা সারা জীবন আমার সঙ্গেই ছিলেন। মাকে ছাড়া আমাদের প্রথম ঈদ হতে যাচ্ছে। কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছে, ঈদের দিনটা আমার জন্য খুবই কঠিন সময় হবে।

করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় সরকার তৈরি পোশাকশ্রমিকদের চার মাসের বেতনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছে। তবে ঈদ বোনাস দেওয়ার টাকা জোগাড় করাটা বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল। চলতি বছরের ঈদের পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে কিছুটা উন্নত।

করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় সরকার তৈরি পোশাকশ্রমিকদের চার মাসের বেতনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছে। তবে ঈদ বোনাস দেওয়ার টাকা জোগাড় করাটা বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল। চলতি বছরের ঈদের পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে কিছুটা উন্নত। তারপরও ঈদের মধ্যে ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা মাথার মধ্যে থাকবেই। ছয় মাস আগেও আমরা ভাবছিলাম, টিকা চলে এলে করোনা আর থাকবে না। কিন্তু টিকা আসার পরও করোনা ভালোভাবেই রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় কাল যে নতুন কোনো ধরন ছড়িয়ে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুক্তরাষ্ট্র মাস্ক পরার বিষয়টি শিথিল করেছে। কিন্তু কাল যদি ভারতীয় ধরন সেখানে আক্রমণ করে, তাহলে ঘটনা বদলে যাবে। সব মিলিয়ে নিরাপদ বোধ করতে পারছি না। অস্বস্তি রয়েই গেছে।