সময়ের পরিবর্তনের সাথে বদলায় নির্ভরতার ধরণও। একসময় বৃষ্টি মেঘ আর রোদের হিসেবে বীজ বপন, চারা রোপণ বা ফসল ঘরে তোলার কাজ হলেও এখন নির্ভরতা যন্ত্রে। দেশে জিডিপির প্রায় একপঞ্চমাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও ঘটে কৃষিকে অবলম্বন করেই। সময়ের সাথে সাথে সেই জলবায়ু ও প্রকৃতিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাতেও এসেছে পরিবর্তন। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জোর দিয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে গত ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। উৎপাদন খরচ যেমন কমেছে, তেমনি শস্য সংগ্রহের পর অপচয়ও কমেছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কৃষি আধুনিকায়নে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রনালয়। এখন তরুনরাও আগ্রহী হচ্ছে কৃষিতে। বর্তমানে কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ শতাংশ তরুণ, নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা কৃষকদের গড় বয়স ৩৫।
বাংলাদেশে এই প্রথম এসেছে ৭ সারির রাইডিং টাইপ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার। সম্প্রতি মধুপুর বি এ ডি সি বীজ উৎপাদন খামারে এ সি আই মটরস-এর আমদানিকৃত এই ইয়ানমার রাইডিং টাইপ ট্রান্সপ্লান্টারের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায় ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে আড়াই বিঘা জমিতে এক ঘন্টায় চারা রোপন করা সম্ভব। যার ফলে সময় যেমন সাশ্রয় হচ্ছে ঠিক তেমনি উৎপাদন খরচও কমে আসছে। এছাড়াও ইয়ানমার ওয়াকিং টাইপ ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে প্রায় ৪০ মিনিটে ১ বিঘা জমিতে চারা রোপন করা যায়। এটি ৪ সারির যন্ত্র যার মূল্য চার লাখ টাকা আর এতে শতকরা ৫০ ভাগ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে অন্তত ১০০ জন সরকারি ভর্তুকিতে ওয়াকিং টাইপ ট্রান্সপ্লান্টারটি সংগ্রহ করেছেন। এবং এর চাহিদা বেড়ে চলেছে।
কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, এমনটাই মনে করেন বিএডিসি'র বীজ উৎপাদন খামার এর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সঞ্জয় রায়। তিনি আরো বলেন ‘সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এর মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ কে কমিয়ে আনতে চাচ্ছে, এই ক্ষেত্রে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও ফসল কাটার জন্য হারভেস্টার একটি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।’ ইয়ানমার রাইডিং টাইপ ট্রান্সপ্লান্টারে সারির সংখ্যা ৭ । প্রতি সারির মধ্যে ব্যবধান ২৫ সেন্টিমিটার আর প্রতি চারার মধ্যে ব্যবধান রাখা যায় ১০ থেকে ২২ সেন্টিমিটার।
ইয়ানমার রাইডিং টাইপ ট্রান্সপ্লান্টার কে বাংলাদেশের জন্য খুবই উপযোগী উল্লেখ করে বিএডিসি'র বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক দেবদাস সাহা বলেন ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বোরো মৌসুমে শুধুমাত্র বৃষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু আমরা ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে অল্প সময়ে অনেক জমি ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারবো যাতে করে আমাদের চাষী উপকৃত হবে, আমাদের দেশ লাভবান হবে।’
কৃষক মো. সালাম বলেন ‘মেশিনটা আসাতে আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে, লেবারের সাশ্রয় হয়। আগে কাজ করতে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা হয়ে যেত আর এখন পরিশ্রম করতে হয় না। এটা আমাদের মতো চাষিদের জন্য খুবই কার্যকরি।’
কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন ‘আগে আমাদের দেড় একর জমি লাগাতে ষোলো জন লোক লাগতো। মেশিন আসাতে লোক লাগে দুই জন আর মেশিনে ৫- থেকে ৬ লিটার তেল লাগে। মেশিনে লাইনগুলা সোজা হয়, নিড়ানের জন্য খুব সুবিধা হয়।
ট্রান্সপ্লান্টার তরুণদের কৃষিখাতে আগ্রহী করবে বলে মন্তব্য করেন, এ সি আই মটরস লিমিটেড এর নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস। তিনি আরো বলেন, ‘কেউ যদি ট্রান্সপ্লান্টার একটা নিয়ে বছরে ৭৫ দিন আসেপাশের মানুষের জন্য ট্রান্সপ্লান্টিং করে দেয় তাহলে আমার ধারণা সে বছরের আড়াই লাখ টাকার বেশি ইনকাম করতে পারবে। এখন তো মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে বিশেষ করে তরুনরা জবলেস হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য এটা একটা ভাল অপশন হতে পারে।’
এ সি আই মটরসকে ধন্যবাদ দিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তরুণ উদ্যোক্তা দেবাশীষ কর তিনি জানালেন, ছাত্রজীবন থেকেই কৃষি যন্ত্রের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়, পড়া লেখা শেষে গ্রামে ফিরে তিনি একটি হারভেস্টর কিনেন। তিনি আরো বলেন ‘আমি এই প্রোডাক্টটা নেওয়ার পর থেকে এ সি আই মটরস এর কাছ থেকে সার্ভিসটা পেয়েছি, ছয় ঘণ্টার মাঝে অন স্পট সার্ভিস, এই সার্ভিস টা খুবই ভালো একটা সার্ভিস ছিল। এমন কখনো হয় নাই যে আমাকে সার্ভিসিং এর জন্য বসে থাকতে হয়েছে।’
দেবাশীষ করের মতো অনেকেই ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র কিনে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। এক্ষেত্রে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার হতে পারে অপার সম্ভাবনার একটি যন্ত্র।