বিশ্ব অর্থনীতি

যত ঝুঁকি একুশের

গত বছর থেকে বিশ্বের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে ‘ঝুঁকি’ বিষয়টি। বৈশ্বিক ঝুঁকি আগেও ছিল, তবে করোনা নামের এক ভাইরাস যেন ঝুঁকি মোকাবিলা অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। কত যে জটিলতায় বিশ্ব এখন। প্রথমত, কত দিন স্থায়ী হবে এই করোনা, তা নির্ণয় করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির নেতৃত্বের পটবদল, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার হামলার মতো ঝুঁকি। এ বছর মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়ার কথা রয়েছে ম্যার্কেলের, বিশ্ব থেকে একরকম আলাদা হয়ে তুরস্কের শীতল অবস্থান, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা বৈশ্বিক ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ঝুঁকি গবেষণা ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে।

চলে গিয়েও চলে যাননি ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন জো বাইডেন। এ অবস্থায় ঝুঁকিটা হলো, নির্বাচনে হারলেও গতবারের চেয়ে এক কোটি ভোট বেশি পেয়েছেন ট্রাম্প। জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। গত চার বছরে বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী যে মনোভাব ট্রাম্প দেখিয়েছেন, তার বেশ কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেছে। তুমুল সমালোচিত ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা না কমে বরং বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অনেককেই অবাক করেছে। এ অবস্থায় ট্রাম্প ব্র্যান্ডের প্রতি অনুগত একটি বিরোধী দলের মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যাওয়া বাইডেনের জন্য বেশ কঠিন হবে। ইউরেশিয়া মনে করছে, বাইডেনের কাজে মূল বাধা আসবে ভেতর থেকে।

কোভিডের স্থায়িত্ব

করোনার ভ্যাকসিন চলে এসেছে, দেশে দেশে এটি প্রয়োগও হচ্ছে। তবে এটা বলার এখনো সময় আসেনি যে করোনা এ বছর অদৃশ্য হয়ে যাবে। ঝুঁকি এখন বিশ্বের সব দেশে সময়মতো করোনার টিকা প্রয়োগ। করোনা সরকারগুলোকে ইতিমধ্যে উচ্চ ঋণে বেঁধে ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমবাজারের অস্থিরতা। অনেক শ্রমিকই স্থান পরিবর্তন করেছেন, প্রণোদনার সঠিক বণ্টনসহ নানা বিষয়ে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে—এমন ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। দেশে দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ভিন্ন হার জনগণের অশান্তি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। উদীয়মান বাজারগুলো আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। একটি কে-আকারের পুনরুদ্ধার হতে পারে। এর মানে হলো, কিছু গোষ্ঠী সাফল্য লাভ করবে এবং অন্যরা ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বিশ্বকে দুর্দশাগ্রস্ত করবে।

জলবায়ু পরিবর্তন

কয়েক দশকের মধ্যে গত বছর ছিল সর্বোচ্চ উষ্ণ বছর। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা—সব দেশই মধ্য শতাব্দীর মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা, এখন যুক্তরাষ্ট্রও মাঠে রয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে বাইডেন ইতিমধ্যে প্যারিস চুক্তিতে যোগ দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত কেবল ট্রাম্পের জলবায়ু উপেক্ষার বিপরীত নয়, বিশ্ব সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন যুগের এক ধাপ। তবে সমস্যা হলো, শক্তি স্থানান্তরের বিষয়টি প্রতিযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাব দ্বারা প্রভাবিত হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব

ট্রাম্পের প্রস্থানের পর মার্কিন-চীন সম্পর্কে আর এতটা দ্বন্দ্ব থাকবে না, বিশ্লেষকেরা অনেকটা এমনই মনে করেন। দুই পক্ষই শ্বাস নেওয়ার কিছুটা সময় পাবে। তবে কতক্ষণ এই স্বস্তিদায়ক অবস্থা থাকবে, তা একটা প্রশ্ন বটে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের এ নিয়ে যথেষ্ট মাথাব্যথা রয়েছে। তাই বলা যায়, এ বছর এই দুই মহারথীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা গত বছরের মতোই তীব্র থাকবে এবং বিপজ্জনক হবে। একতরফাভাবে কঠোর চীন নীতি অনুসরণকারী ট্রাম্প প্রশাসনের বিপরীতে গিয়ে বাইডেন একটি বহুপক্ষীয় মিত্রবাহিনী গড়ে তুলবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও ভারত মার্কিন প্রচারের মূল লক্ষ্য হবে। মিত্রদের তালিকাভুক্ত করার জন্য মার্কিন প্রচেষ্টা, ভ্যাকসিন কূটনীতি এবং জলবায়ু প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করবে।

শান্ত তুরস্ক

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তুরস্ক এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সদস্য দেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র দেশটির প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বাড়তে পারে। রাশিয়ার কাছ থেকে এস ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র-ব্যবস্থা কেনাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ আরোপের মূল কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তবে আসল বিষয় হলো, মুসলিম বলয়ে তুরস্কের স্বতন্ত্র অবস্থান পাশ্চাত্য স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের বাজারে তুরস্কের উত্থানকেও ইউরোপ-আমেরিকা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে, যা আঙ্কারার জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ, মার্কিন অবরোধ প্রতিরক্ষা খাত থেকে বাণিজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

সাইবার ঝুঁকি

দুর্বল ডিভাইস সুরক্ষা, কার্যকর কূটনীতির অনুপস্থিতি এবং সাইবার প্রতিক্রিয়ার ওপর অধিক জোরের অর্থ সাইবার স্পেসে অস্থিতিশীলতা। ২০২১ সালে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা শক্ত হবে। বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যাক। করোনার কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন অনলাইনের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। এই ক্রিয়াকলাপের বেশির ভাগই হচ্ছে কম সুরক্ষিত বাসার কম্পিউটার বা নেট সংযোগ ব্যবহার করে, যা ঝুঁকিপূর্ণ। এই বছর ৫-জি নেটওয়ার্ক প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট অব থিঙ্কস সেন্সর, ক্যামেরা এবং অন্যান্য ডিভাইসের বিস্তৃতিও ঘটবে। ইন্টারনেটে যুক্ত হওয়া নতুন ডিভাইস বাড়বে। এই ডিভাইসগুলোকে হ্যাকিং থেকে রক্ষা করার জন্য আলাদা কিছু নেই, কেবল নিয়মিত আপডেট করে কাজটা করা হয়, যা পুরোপুরি ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম নয়।

কম দামি তেল

করোনার কারণে বিদায়ী বছরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির চাহিদার ব্যাপক পতন হয়, যা আলজেরিয়া থেকে শুরু করে ইরান পর্যন্ত দেশগুলোর অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার শক্তি উৎপাদনকারী দেশগুলো ২০২০ সালে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। এ বছর তাদের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগেই সরকারগুলো অস্থিতিশীল ছিল। এখন সেই চাপের সঙ্গে সঙ্গে সুষ্ঠু ভ্যাকসিন বিতরণের চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানির দামও কম থাকবে। অনেকে ব্যয় কমাবে, যা ক্ষতিগ্রস্ত করবে বেসরকারি খাতকে, বেকারত্ব বাড়িয়ে তুলবে। জনরোষ বাড়বে।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ইরাক। দেশটির সরকারের আয়ের ৮০ ভাগই আসে তেল থেকে। তেলের দাম কম মানে রাষ্ট্রীয় ব্যয় মেটানোর পর্যাপ্ত সংস্থান না হওয়া, মুদ্রার অবমূল্যায়ন থামাতে না পারা। আবার জনরোষের দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে আলজেরিয়া। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট আবদেলাজিজ বোতেফ্লিকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর থেকে দেশটিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। এ বছর তেলের কম দাম মাথাব্যথার কারণ সৌদি আরবের জন্যও।

ম্যার্কেলের চলে যাওয়া

এ বছর মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়ার কথা রয়েছে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের। ২০০৫ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। মেয়াদ শেষে তিনি আবার দাঁড়াবেন, এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। দীর্ঘ এই শাসনামলে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট, এর এক বছর পর গ্রিসের ঋণসংকট এবং পাঁচ বছর আগে অভিবাসী সংকটের মধ্যেও জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কান্ডারি হয়ে থেকেছেন ম্যার্কেল। এত সব সংকট সামলানো ম্যার্কেলের জন্যও কোভিড-১৯ মহামারি সবচেয়ে কঠিন সময় এনে দেয়। ১৫ বছরের মধ্যে ২০২০ সালকেই তাঁর সবচেয়ে ভারী বলে মনে হয়। এ পরিস্থিতিতে ম্যার্কেলের চলে যাওয়া নতুন ঝুঁকিই তৈরি করবে।