মুশতাকের স্বপ্নের কুমিরের খামারটি ২০১৩ সালে দখলে নেন পি কে হালদার। এরপর প্রতিষ্ঠানটির নামে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ বের করে নেন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক অবস্থায় কারাগারে মারা যাওয়া মুশতাক আহমেদ ছিলেন দেশের প্রথম কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অন্যতম অংশীদার। সেই কুমির খামারের মালিক এখন আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। আর কুমির খামারটি পি কে হালদারের হাতে তুলে দেন মুশতাক আহমেদের ব্যবসায়িক অংশীদার মেজবাহুল হক। তিনি বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক। ২০১৩ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকার সময় পি কে হালদার কুমির খামারটির নিয়ন্ত্রণ নেন।
এখন ময়মনসিংহের রেপটাইলস ফার্মটি আবার ব্যাংকবহির্ভূত আলোচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্সের অন্যতম মালিক। এই এফএএস ফাইন্যান্স থেকেও নামে-বেনামে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছিলেন পি কে হালদার। মুশতাক আহমেদের খামারটি পি কের দখলে যাওয়ার পর সেটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, কেএইচবি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজীব সোম ও তাঁর স্ত্রী শিমু রায়। নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রেপটাইলস ফার্মের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণও বের করে নেন পি কে হালদার, যা আর শোধ হচ্ছে না।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক খাতের আলোচিত পি কে হালদার পালিয়েছেন বিদেশে। পি কের বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারির অংশীদার রাজীব সোমও এখন পরিবার নিয়ে কানাডায় থাকেন। ফলে কুমিরের খামারটিও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। মুশতাক আহমেদের হাতছাড়া হওয়ার পর কুমির চাষের বদলে খামারটির নাম ও জমি ব্যবহার হয়েছে মূলত ঋণ নেওয়ার কাজে। গত বছর কানাডায় যাওয়ার আগে রাজীব সোমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের। তিনি সে সময় বলেছিলেন, কুমির খামারটির মালিক মূলত পি কে হালদার। তাঁর হাতে আছে অল্প শেয়ার।
জানা যায়, মুশতাক আহমেদের উদ্যোগে ২০০৪ সালে রেপটাইলস ফার্মটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত সমমূলধন সহায়তা তহবিল বা ইইএফ থেকে ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ পায় খামারটি। এ বিনিয়োগের বিপরীতে খামারটির ৪৯ শতাংশ মালিকানা পায় ইইএফ। আর বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের এবং ১৫ শতাংশ মুশতাক আহমেদের। প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ছিল ৫ কোটি টাকা।
রেপটাইলস ফার্মের পর্ষদে মেজবাহুল হক এবং মুশতাক আহমেদ ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালক। তাঁদের মধ্যে মেজবাহুল হক ছিলেন খামারটির চেয়ারম্যান এবং মুশতাক আহমেদ ছিলেন এমডি। আর ইইএফের ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সাউথইস্ট ব্যাংকের তৎকালীন কর্মকর্তা প্রীতীশ কুমার সরকার ছিলেন মনোনীত প্রতিনিধি। বর্তমানে প্রীতীশ কুমার সরকার এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি। আবার এফএএস ফাইন্যান্সের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে খামারটি।
জানতে চাইলে প্রীতীশ কুমার সরকার গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবই কাকতালীয়। আমি এসব কিছুই জানি না।’
এদিকে গত মে মাসে জেলে যাওয়ার আগে মুশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, মেজবাহুল হক সম্পর্কে তাঁর মামা। তহবিল–স্বল্পতার কারণে ২০০৪ সালে তাঁকে খামারটির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনি। ওই সময় মেজবাহুল হক মোর্শেদ খানের পক্ষে এবি ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। আর ২০১৩ সালে পি কে হালদারের কাছে খামারটি তুলে দিয়ে মেজবাহুল হক দেশে ছেড়ে চলে যান। পরে একই বছর পি কে হালদারের ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডের বাসায় মুশতাক আহমেদও তাঁর নামে থাকা খামারটির শেয়ার হস্তান্তরের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।
মুশতাক আহমেদ ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর ফেসবুকে খামারটির মালিকানা বদল নিয়ে যে লেখাটি দিয়েছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘কুমিরের খামার এখন হায় হায় কোম্পানি।’ তিনি লিখেছিলেন, ‘২০১০ সালের ৩রা জুন ছিল বিশেষ দিন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কুমির রপ্তানি হবে। …এর দুই মাস পর তিনি (কোম্পানি চেয়ারম্যান, মেজবাহুল হক) ঘোষণা দিলেন, কোম্পানি বিক্রি করে দেবেন, আমাকে একটা সাদা কাগজ দিয়ে বললেন সেখানে সাইন করতে। আমি বলে দিলাম সেটা সম্ভব না। শুরু হলো ঝামেলা, কোর্ট–কাচারি। এরপর প্রশান্ত (প্রশান্ত কুমার হালদার) এল সামনে। …তিনি আমাকে যা বললেন, তাতে বুঝলাম, প্রশান্তের কথায় রাজি না হলে, আমার আম–ছালা দুইটাই যাবে। একপর্যায়ে আমি আমার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হলাম।’
মুশতাক আহমেদ আরও লিখেছেন, ‘চেয়ারম্যান (মেজবাহুল হক) তখন আবার এবি ব্যাংকের ডিরেক্টর ছিলেন, তাই ব্যাংকের কোনো নিয়ম–নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রশান্তকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে ফার্মের সমস্ত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করে ফেলেন। কোম্পানির সমস্ত কাগজপত্র নতুন করে তৈরি করা হয়। সমস্যা দেখা দেয়, যখন জন্মের সময় নয় ইঞ্চি কুমির ছানা দশ বছর পরে আট নয় ফুট লম্বা হয়ে যায়। ৩২০০ কুমির কিলবিল করতে থাকে। …প্রশান্ত কুমিরের ফার্মের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে জমি কিনে, শেয়ার কিনে, কিন্তু কুমির বেচতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের মতো পালায় দেশ ছেড়ে। পান্থপথের ঝকঝকে অফিসে এখন পিয়ন ছাড়া কেউ যায় না। ভালুকার ফার্মে তালা দিয়ে কর্মকর্তারা পলাতক। কর্মচারীরা প্রায় কয়েক মাস যাবৎ বেতন না পেয়ে অসহায় দিন যাপন করছে। …সিম্পলের মধ্যে গরজিয়াস একটা কুমিরের খামার এখন হায় হায় কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।’