মেস–গ্যারেজে খাবার

মাছের টুকরা ছোট হয়েছে, ডাল হয়েছে আরও পাতলা

নলা মাছ, বেগুন ও আলুর তরকারি। সঙ্গে ডাল।

এগুলো রাজধানীর হাতিরঝিল থানার মিরবাগে ইউনুস মিয়ার রিকশার গ্যারেজের গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের খাবারের পদ। বেলা দুইটার দিকে গিয়ে দেখা গেল, ৩০ জনের মতো রিকশাচালক খাচ্ছেন। কেউ কেউ অপেক্ষায়। খাবারের থালার দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, মাছের টুকরাটি একেবারেই ছোট। ডালও পানির মতো পাতলা।

রিকশাচালক শাকিল আহমেদ তখন দুপুরের খাবার খেতে এসেছেন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, গ্যারেজে দুই বেলা খেতে এখন ১১০ টাকা লাগে। দু-এক মাসে খাবারের দাম বাড়েনি। তবে মাছ অথবা মাংসের টুকরা ছোট হয়েছে। আগে দুই বেলাই মাছ অথবা মাংস থাকত। এখন রাতে আলুভর্তা ও ডাল দেওয়া হয়। তিনি বলেন, মসুরের বদলে এখন রান্না করা হয় অ্যাংকর ডাল। এই ডাল আরও পাতলা হয়েছে।

ঢাকায় এই রিকশার গ্যারেজের মতো ছোট চাকরিজীবীদের মেস, ছাত্রদের যৌথ খাবার ব্যবস্থা এবং চাকরিজীবীদের জন্য টিফিন বক্সে খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রে কোথাও দাম বেড়েছে, কোথাও দাম না বাড়িয়ে মাছ-মাংসের টুকরা ছোট করা হয়েছে। সব মিলিয়ে খাবারের মানে ছাড় দিয়ে খরচ পোষানো হচ্ছে।

শুধু ঢাকায় নয়, দিনাজপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও একই চিত্র।

বাবার অবস্থা দেখে বাড়তি টাকা চাইতেও বিবেকে বাধে।
রাফিউল ইসলাম, দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী

এই পরিস্থিতি তৈরির কারণ নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৮ টাকা, যা এখন ৪৫ টাকা। ৭৮ টাকা লিটারের খোলা সয়াবিন তেল এখন ১৮২ টাকা। মোটা দানার মসুর ডালের দাম ৫৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৫ টাকা। সঙ্গে বেড়েছে মোটামুটি সব ধরনের নিত্যপণ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম।

এই মূল্যবৃদ্ধি মানুষের সংসারের ব্যয় বাড়িয়েছে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়িয়েছে। মেসে মিল (এক বেলার খাবার) খরচও বেড়েছে একই কারণে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিব হাসান রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকার আটজনের একটি মেসে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শেষের দিকেও মেসে খাওয়ার পেছনে মাসে ব্যয় হতো ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা। এখন সেটা বেড়ে তিন হাজার টাকার আশপাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা সপ্তাহে এক দিন গরুর মাংস খেতাম। সেটা বাদ দিয়েছি।’

লক্ষ্মীবাজারেই আরেকটি মেসে থাকেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মিলন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সপ্তাহে দুই দিন দুপুরে শুধু সবজি দিয়ে ভাত খাব। খরচ আর পোষানো যাচ্ছে না।’

রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান, দোকান, ছোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ও সরকারি সংস্থায় দুপুরে খাবার সরবরাহ করেন বিভিন্ন ব্যক্তি। শামীম আরা বেগম তেমনই একজন। তিনি রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় খাবার সরবরাহ করেন।

শামীম আরা প্রথম আলোকে বলেন, মাছ অথবা মাংস, সবজি ও ডালের একটি প্যাকেজের দাম তিনি জনপ্রতি ৮০ টাকা রাখতেন। পোষাতে না পেরে পবিত্র রমজান মাসের আগে প্যাকেজটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর সরবরাহ করা খাবারের ১২০ টাকার একটি প্যাকেজ ছিল। সেটির দাম বাড়িয়ে ১৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, আগে প্রতি মাসেই নতুন নতুন ক্রেতা পেতেন। এখন তেমন একটা পান না। পুরোনো ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিয়ে কথা শুনতে হয়।

এক মুরগি ১৮ টুকরা

দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম কলেজের প্রধান ফটকের বিপরীতে একটি মেসে থাকেন। তিনি গত রোববার সকাল নয়টায় মেসের বাজার করে ফিরছিলেন।

কী কী কিনেছেন, জানালেন আশরাফুল। বাজারের ফর্দে দেখা গেল, ১৮ জনের জন্য ৫৪০ টাকার বাজার করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ১৭০ টাকার একটি ব্রয়লার মুরগি, ১০০ টাকার সয়াবিন তেল, ২৫ টাকার ডাল, ৪০ টাকার পেঁয়াজ-মরিচ, ৬০ টাকার আলু, ২০ টাকার আদা-রসুন, ২০ টাকার মসলা এবং ১০৫ টাকার করলা ও ঝিঙে।

আশরাফুল জানান, মুরগিটি ছোট ছোট করে ১৮ টুকরা করা হবে। দুপুরের খাবার হবে মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি দিয়ে। সকাল ও রাতে খাবারের পদ হিসেবে থাকবে ডাল ও আলুভর্তা/সবজি। তিনি জানান, চাল বাদে তাঁদের মেসে দিনে জনপ্রতি ২৫ টাকার মধ্যে তিন বেলার তরকারি (দুই বেলায় মূলত পাতলা ডাল ও ভর্তা/সবজি) রান্না হতো। এখন সেটার ব্যয় বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে। চাল প্রতিদিন কৌটায় করে প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হয়।

দিনাজপুর শহরের ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁশেরহাট পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার পথ। এর মধ্যে পড়েছে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সরকারি সিটি কলেজ এবং সরকারি মহিলা কলেজ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী মেসে থেকে পড়াশোনা করেন।

নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা কষ্টে আছেন। দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাবার আয়রোজগার কম। প্রতি মাসে থাকা-খাওয়া বাবদ দুই হাজার টাকা করে দিতেন। গত মাস থেকে ৫০০ টাকা বাড়িয়েছেন। তাতেও কুলাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাবার অবস্থা দেখে বাড়তি টাকা চাইতেও বিবেকে বাধে।