ছোটবেলায় দেখতাম একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গায়ে বিভিন্ন ধরনের ও মানের স্কুল পোশাক। ধরেন, কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক নেভি ব্লু হলেও সবার পোশাকের রং একই রকম হতো না। কেউ নীল বানাত, কেউ আকাশি, কেউ–বা কাছাকাছি অন্য কোনো রঙের। কাপড়ের মানেও ছিল বেশ পার্থক্য। যার কারণ ছিল সবাই আলাদা দরজি থেকে নিজ নিজ আর্থিক সামর্থ্য অনুসারে পোশাক বানিয়ে নিত। এ সমস্যা সমাধানের চিন্তা থেকেই মাইনুল হাসান গড়ে তোলেন ‘ডি স্মার্ট ইউনিফর্ম সলিউশন’।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. মাইনুল হাসান জানান, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দামে সমমানের পোশাক বানিয়ে দেওয়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে তাঁর ব্যবসা করার ইচ্ছা মাথাচাড়া দেয়। তবে সেই ব্যবসা যাতে শুধু অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার না হয়ে সমাজের উপকারে লাগে, সেই রকম কিছুই করতে চেয়েছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত স্মার্ট ইউনিফর্ম সলিউশনের কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির নানা দিক নিয়ে কথা হয় মাইনুল হাসানের সঙ্গে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতে সাভারের একটি বিদ্যালয়ের ২০০ শিক্ষার্থীর স্কুল পোশাক বানানোর কাজ পায় মাইনুলের স্মার্ট ইউনিফর্ম সলিউশন। এরপর একটু একটু করে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিসর।
মাইনুল হাসান বলেন, ‘আমরা প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক বা ড্রেস বানানোর ক্রয়াদেশ নিই। এরপর আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কারখানা থেকে ভালো মানের কাপড় দিয়ে তা বানিয়ে দিই। এতে সবার কাপড়ের মান যেমন একই থাকে, তেমনি দামও ভিন্ন ভিন্ন হয় না। ব্যবসা শুরুর চার বছর না যেতেই বেশ সফলতাও পেয়েছি। মিলেছে স্বীকৃতিও। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে ১১টি জেলার ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পোশাক বানিয়ে দিয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা ধাক্কা খেলেও এখন আবার ফিরেছে আগের ছন্দে।’
মাইনুল বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সালে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও প্রথম ব্যবসা শুরু করি ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে। ওই সময় এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে ও তাঁর কাছ থেকে পাওয়া ১০ হাজার টাকায় বেশ কিছু জার্সি বানাই। ১০-১৫ দিনের মধ্যেই সেসব জার্সি বিক্রি করে প্রায় ৮০ হাজার টাকার মতো আয় করেছি। সেই পুঁজি নিয়ে ওই বছরই ঈদ উপলক্ষে একটু বড় পরিসরে নিজস্ব ডিজাইনের পাঞ্জাবি ও টি-শার্ট বানাই। কিন্তু সেবার লাভের বদলে লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু হাল ছাড়িনি। লাভ-ক্ষতির অভিজ্ঞতা নিয়ে ছোট পরিসরে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যাই।’
মাইনুল আরও বলেন, ‘ব্যবসার এ লাভ-ক্ষতির থেকে আমি যেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তেমনি গড়ে উঠেছে একটি নেটওয়ার্ক। এই দুটিকে পুঁজি করেই ২০১৭ সালে এসে স্মার্ট ইউনিফর্ম সলিউশন চালু করি।’
আলাপকালে মাইনুল আরও জানান, ‘মাত্র পাঁচজন কর্মী নিয়ে শুরু করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে স্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন ২৩ জন কর্মী। এ ছাড়া অস্থায়ী ভিত্তিতে আরও ৫০০ জন কর্মী আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ঢাকা, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, রংপুর, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নীলফামারী পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকের পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণও সরবরাহ করছে তারা। কয়েক লাখ টাকা দিয়ে শুরু করা এ ব্যবসায় এখন বিনিয়োগ প্রায় চার কোটি টাকা। তার বিপরীতে আয় পাঁচ কোটি টাকা।’
প্লে থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে পোশাক বানান তাঁরা। পোশাকের মান, ধরন, খরচসহ বিস্তারিত তথ্য তাঁরা জমা দেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পরে ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাজার যাচাই-বাছাই করে তাঁদের কার্যাদেশ দেয়। প্রতিটি পোশাক ৫০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে বানিয়ে দেয় স্মার্ট ইউনিফর্ম সলিউশন। এ ছাড়া তারা শীতের পোশাক, শু, ব্লেজার ও টাই, ব্যাগ, আইডি কার্ড, শোল্ডার ব্যাজ, এমব্রয়ডারি লোগো, টুপি, খেলাধুলার সামগ্রীসহ সব ধরনের স্টেশনারি সামগ্রীও বিক্রি করে। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে ৩১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। মাইনুল হাসান বলেন, ‘আশা করছি খুব দ্রুতই আমরা দেশের বিভিন্ন জেলার এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারব।’
ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধেও সহায়তা করে প্রতিষ্ঠানটি। মুনাফার একটি অংশ সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।
মাইনুল জানান, তাঁরা তাঁদের আয়ের ১০ শতাংশ অর্থসহায়তা হিসেবে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ফেরত দেন। এ ১০ শতাংশ অর্থ চারটি ভাগে ভাগ করে ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে ৬ শতাংশ অর্থ যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে। ৩ শতাংশ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ে। বাকি ১ শতাংশ অর্থ দেওয়া হয় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যারিয়ার উন্নয়ন সংক্রান্ত সভা-সেমিনার আয়োজনের খরচ হিসেবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফুড পান্ডা, হাংরিনাকি এবং ই-কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ফেডএক্সের সঙ্গেও ব্যবসা রয়েছে স্মার্ট ইউনিফর্ম সলিউশনের। সাত ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম মাইনুল হাসানই তাঁর পরিবারের মধ্যে প্রথম ব্যবসায় পা বাড়ান। পরে তাঁর কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন আরও তিন ভাই। এর মধ্যে বড় ভাই যুক্ত আছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ক্যাফেটেরিয়া ‘ডি ক্যাফে’ পরিচালনার দায়িত্বে। আরেক ভাই দেখভাল করছেন আশুলিয়া অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিচালিত আবাসিক হোস্টেল ‘ড্রিমার্স ভ্যালি’ এবং পোশাকের ব্র্যান্ড শপ ‘দ্য স্মার্ট কালেকশন’–এর কার্যক্রম। আর সবার ছোট ভাই পরিচালনা করছেন ‘দ্য স্মার্ট লজিস্টিকস’। শুধু ভাইদেরই নয়, মাইনুলের নানা ব্যবসায়ী উদ্যোগে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর। মাইনুল বলেন, ‘ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে আমি বড় স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছি। আশা করছি একসময় এসব উদ্যোগ অনেক বড় হবে।’