মজুরি বাড়ছে, আওতা কমছে

দেশব্যাপী পরিচালিত ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) আওতা কমছে। এখন যেমন সব উপজেলায় কর্মসূচিটি চলছে, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে তা আর রাখা হবে না। তবে বর্তমানে কর্মসূচির আওতায় ২০০ টাকা করে যে দৈনিক মজুরি দেওয়া হচ্ছে, তা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হবে। সেটিও আগামী অর্থবছর থেকেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এমন মতামত জানিয়ে ৩ ডিসেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

দরিদ্রদের জন্য বিদ্যমান দৈনিক মজুরি বাড়াতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কয়েক মাস ধরেই অর্থ বিভাগে আবেদন জানিয়ে আসছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিও এ ব্যাপারে সুপারিশ করেছে।

কিন্তু অর্থ বিভাগ দেখেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মাঝখানে দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করতে গেলে যে বাড়তি বরাদ্দ দরকার, বাজেটে তা ধরা নেই। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ধরা আছে মোট ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। কিন্তু দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা করতে গেলে লাগবে মোট ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে বাড়তি লাগবে ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। তাই অর্থ বিভাগ মনে করছে, এখন বছরের মাঝখানে এসে মজুরির হার বাড়ানো হলে তাতে চলমান অন্যান্য কর্মসূচির অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

অর্থ বিভাগ বলেছে, ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান’ কর্মসূচিটি মূলত হতদরিদ্র বেকার জনগণের জন্য। এ ধরনের কর্মসূচিতে দৈনিক মজুরির হার বাজারদর অপেক্ষা কম রাখা হয়, যাতে এ থেকে উপকার পেতে পারেন একেবারেই হতদরিদ্র জনগণ। ফলে এ ধরনের কর্মসূচিতে দৈনিক মজুরির হার বাড়ানো হলে অপেক্ষাকৃত কম দরিদ্র বা দরিদ্র নয়, এমন জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের প্রবণতা বাড়বে। এতে অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র জনগণের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬ সালের সর্বশেষ খানা জরিপ করেছিল। তাতে উপজেলাভিত্তিক দারিদ্র্যের মানচিত্র করা হয়। সেই মানচিত্রের কথা উল্লেখ করে অর্থ বিভাগ বলেছে, নীতিমালা সংশোধন করে সারা দেশের পরিবর্তে শুধু অতিদরিদ্রপ্রবণ এলাকায় কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করা যায়। যেসব উপজেলায় অতিদরিদ্রের হার ৩০ শতাংশের বেশি রয়েছে, বেছে নেওয়া যায় শুধু সেগুলোকেই।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনাসচিব মো. মহসিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ বিভাগের চিঠি আমরা পেয়েছি। এখন একটি পরিকল্পনা দাঁড় করাব। তবে এটা ঠিক যে অতিদরিদ্র হার কম—এমন এলাকায় কর্মসূচিটি পরিচালনার বাস্তবতা কম।’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে বিদ্যমান বরাদ্দের মাধ্যমেই দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

দেশের ২২১টি উপজেলায় অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ৩০ শতাংশের বেশি। আর ৩৫ শতাংশের বেশি রয়েছে ১৬৫টি উপজেলায়। আর অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ১৫ শতাংশের নিচে রয়েছে ১৫৩টি উপজেলায়। এমনকি ৫ শতাংশের কম থাকা উপজেলাও কম নয়।

অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতেই যাতে মজুরি বৃদ্ধির কার্যক্রম চালু করা যায়, এ জন্য ২০১৩ সালে করা ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি নির্দেশিকা’ সংশোধন করতে হবে।

বিবিএসের ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২২১টি উপজেলায় অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ৩০ শতাংশের বেশি। আর ৩৫ শতাংশের বেশি রয়েছে ১৬৫টি উপজেলায়। আর অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ১৫ শতাংশের নিচে রয়েছে ১৫৩টি উপজেলায়। এমনকি ৫ শতাংশের কম থাকা উপজেলাও কম নয়। যেমন অতিদরিদ্রের হার ঢাকার গুলশান উপজেলায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ও দোহারে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। এই হার মাদারীপুরের রাজৈরে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, চট্টগ্রামের কোতোয়ালিতে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে ৪ শতাংশ।

দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভূমিহীন, অদক্ষ, মাসিক আয় চার হাজার টাকার কম, কাজহীন ব্যক্তিদের জন্য তথা দুস্থ পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দিতে ইজিপিপি চালু করা হয়। কাজের মধ্যে রয়েছে পুকুর, খাল খনন, বাঁধ-রাস্তা নির্মাণ, সেচকাজের জন্য ও জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য খাল, নালা খনন ইত্যাদি।

অতিদরিদ্রদের নিয়ে গবেষণা করা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের কর্মসূচিতে দক্ষতার সঙ্গে প্রকৃত উপকারভোগী বাছাই করা উচিত। আর তাঁদের মজুরির হার হওয়া উচিত বাজারদরের অর্ধেক, বড়জোর ৬০ শতাংশ। কোভিডের এই সময়ে কর্মসূচিটির আওতা না কমিয়ে বরং নদীভাঙন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকেন, এমন নতুন নতুন এলাকায় সম্প্রসারণ করা উচিত। শহরের অতিদরিদ্র মানুষ যাতে এ কর্মসূচির মধ্যে থাকতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও থাকতে হবে।’