ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজার ও দোকানে নির্ধারিত নতুন দরের চেয়েও বাড়তি দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে।
নতুন দাম কার্যকর হওয়ার পর ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন বাজার ও অলিগলির দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে এই তেল মূল্যবৃদ্ধির আগে কিনে রাখা। তেলের বোতলের মোড়কে উল্লেখ করা দরও আগের। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে, যা আগের চেয়ে প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বেশি। এরপরও কোথাও কোথাও সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
তেল বিপণনকারী কোম্পানিগুলো ঈদের পর গতকাল শনিবার থেকে পরিবেশকদের মাধ্যমে নতুন দামে বোতলজাত, খোলা সয়াবিন ও পাম তেল সরবরাহ শুরু করেছে। তবে খুচরা পর্যায়ে সব এলাকায় এই তেল পৌঁছায়নি। সরবরাহ স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন সময় লেগে যাবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।
সরবরাহ ঘাটতির কারণে ঈদের আগে থেকেই বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। আর খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৮০ টাকা এবং পাম তেল লিটারে ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গতকাল থেকে কার্যকর হয় এই দাম।
গতকাল ঢাকার মিরপুর, কারওয়ান বাজার ও পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকার ১৮টি দোকান ঘুরে দেখা যায়, ৮টি দোকানে তেল নেই। বাকি ১০টি দোকানে তেল আছে। এর মধ্যে ৫টি দোকানে গতকাল তেল সরবরাহ করেছেন পরিবেশকেরা। এসব দোকানে নির্ধারিত দরের চেয়েও বাড়তি দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তাঁরা ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
কারওয়ান বাজারে গতকাল দুপুরে বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করেন সিটি গ্রুপের একজন পরিবেশক। এসব তেল মোড়কজাত করা হয় গত ২০ এপ্রিল। বাড়তি দাম কার্যকর হওয়ার পর মজুত রাখা এসব তেল সরবরাহ করেছেন পরিবেশক। আর দোকানিরা ২০০ টাকা লিটার দরে সেই তেল বিক্রি করেন।
মিরপুর–২ নম্বরের বড়বাগ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ মুদিদোকানে সয়াবিন তেল নেই। একইভাবে পশ্চিম তেজতুরী বাজারের বেশির ভাগ দোকানে সয়াবিন তেল ছিল না। হাতে গোনা যে কয়েকটি দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছিল, তাঁরাও ২০০ টাকা লিটারে তেল বিক্রি করছিলেন। আবার এই তেলের বোতলের মোড়কে পুরোনো দাম লেখা ছিল।
সরকার খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিরপুর–২ নম্বরের বড়বাগ বাজারের চারটি দোকানে গতকাল খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। এই বাজারের ‘ভাই ভাই শরীয়তপুর’ দোকানের কর্মীরা বলেন, খোলা সয়াবিনের দাম কেজিপ্রতি ২২০ টাকা। লিটারে নয়, কেজিতে তেল বিক্রি করেন তাঁরা।
অবশ্য মিরপুর-২ নম্বরের বড়বাগ বাজারের চাঁদপুর বাণিজ্যালয়, ইসলাম ট্রেডার্স ও এমরান স্টোরে খোলা সয়াবিন তেল ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। কেন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা রাখা হচ্ছে জানতে চাইলে ইসলাম ট্রেডার্সের বিক্রেতা মো. নাঈম বলেন, ‘বেশি দামে কিনি, বেশি দামে বেচি।’
চট্টগ্রামেও খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত তেল ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল। শহরের জামালখান এলাকার ওয়ার্ল্ড স্টোরে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তেল আছে কি না জানতে চাইলে দোকানি বলেন, প্রতি লিটার ২০০ টাকা দাম দিতে হবে।
কারওয়ান বাজারের মুদিদোকানগুলোয় গতকাল তীর সয়াবিন তেল সরবরাহ করেছেন সিটি গ্রুপের একজন পরিবেশক। দোকানিরা জানান, দুপুরে এক গাড়ি তীর সয়াবিন তেল নিয়ে আসেন পরিবেশক। কারওয়ান বাজারের প্রতিটি দোকানে তাঁরা একটি ২ লিটারের কার্টন (৯টি) ও ১ লিটারের (১৮টি) কার্টন দিয়েছেন। তবে কয়েকটি দোকানে কিছুটা বেশি দিয়েছেন। বোতলের গায়ে উৎপাদনের তারিখ (প্যাকিং) লেখা চলতি বছরের ২০ এপ্রিল। মেয়াদ শেষের তারিখ লেখা আগামী বছরের ১৯ এপ্রিল।
প্রথম আলো তিনটি দোকানে সরবরাহ করা সয়াবিন তেলের বোতল দেখেছে। এর মধ্যে দুটি দোকানে সরবরাহ করা তেলের বোতলের গায়ে লেখা মূল্য মুছে ফেলা ছিল। আর একটি দোকানে সরবরাহ করা তেলের বোতলে মূল্য ১৬০ টাকা লেখা ছিল, যা আগের দাম।
কারওয়ান বাজারের একটি মুদিদোকান থেকে গতকাল বিকেলে তীর ব্র্যান্ডের ২ লিটার সয়াবিন তেলের দুটি বোতল কেনেন বেসরকারি চাকরিজীবী নাসির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো তেল দিয়ে নতুন দাম রেখেছে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৯৮ টাকা লিটার, সেই দাম রাখতে পারত। সেই দামের চেয়েও বেশি রেখেছে। ২০০ টাকা লিটার করে ৪ লিটার তেলে ৮০০ টাকা রেখেছে তারা।
দোকানিরা বলছেন, পরিবেশকের সরবরাহ করা তেলের বোতলের মূল্য লেখা অংশ মুছে দেওয়ায় এ নিয়ে ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবেশকেরা যে পরিমাণ তেল সরবরাহ করছেন, তা দিয়ে সংকট দ্রুত কাটবে না। চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ তেলও দিচ্ছেন না পরিবেশকেরা।
তীর সয়াবিন তেলের বোতলে মূল্য লেখা অংশটি মুছে দেওয়া হলো কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এমনটি হওয়ার কথা নয়। মূল্য অংশটি মুছে তেল সরবরাহ করছেন না তাঁরা। আগের দামেই (লিটার ১৬০ টাকা) তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। কারণ যেগুলো উৎপাদন করা আছে, সেগুলো তো গোডাউন থেকে বের করতে হবে। নতুন তেল সরবরাহ না করা পর্যন্ত ১৬০ টাকা লিটারই রাখার কথা।
বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, কারওয়ান বাজারে গতকাল তাঁরা চারটি ট্রাক পাঠিয়েছেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, নিউমার্কেটেও তেলের ট্রাক গেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত তেল পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
একই কথা বলেছে পুষ্টি ব্র্যান্ড নামে তেল বিপণন করা টিকে গ্রুপও। টিকে গ্রুপের পরিচালক (অর্থ ও পরিচালনা) মো. শফিউল আতহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে উৎপাদন করা তেল আমরা পুরোনো দরেই সরবরাহ করেছি। নতুন দরে এখনো তেল সরবরাহ হয়নি। ক্রেতাদের বোতলের গায়ে দাম দেখে কেনা উচিত।’
মিরপুর–২ নম্বর বড়বাগ বাজারের চাঁদপুর বাণিজ্যালয় দোকানে গতকাল দুপুরে রিকশায় করে আসেন রূপনগর এলাকার দুই ভাই। তাঁরা রিকশা থেকে না নেমেই জানতে চান, সয়াবিন তেল আছে কি না। দোকানি জানান, নেই।
ওই দুই ভাইয়ের সঙ্গে দোকানের সামনে কথা বলেছে প্রথম আলো। বড় ভাই রহমান বলেন, গত দুই দিনে এলাকার অনেক দোকানে খুঁজেছেন, কোথাও পাননি। আজ (শনিবার) রিকশা নিয়ে তেল কিনতে বের হয়েছেন তাঁরা। এখানে আসার আগে রূপনগরের পাশাপাশি শেয়ালবাড়ি ও মিরপুর–১০ নম্বর এলাকা ঘুরেছেন। কিন্তু তেল পাননি। তাঁর অভিযোগ, কিছু দোকানে তেল আছে, কিন্তু বিক্রি করে না। বাজারে নতুন তেলের সরবরাহ বাড়ার পর পুরোনো তেল বেশি দামে বিক্রি করবেন দোকানিরা।
চট্টগ্রামের খুচরা বাজারেও একই অবস্থা। গতকাল বহদ্দারহাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানে তেল নেই। এই বাজারের নাহার স্টোরের দোকানি মারুফ করিম প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানির পরিবেশকেরা এখনো তেল দেননি।
১০০ টাকা খরচ করে আধা লিটার তেল কেনার ক্ষমতা নেই জানিয়ে পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকার গৃহকর্মী মোমেনা বেগম বলেন, ৩০ টাকা দিয়ে ৮০ মিলিমিটার রাঁধুনী সরিষার তেল কিনেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা হয় গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায়। তখন তিনি তেজতুরী বাজার এলাকার একটি গলির দোকানে তেল কিনতে এসেছিলেন।
ঈদের আগের দিন আধা লিটার সয়াবিন তেল কিনেছিলেন মিরপুর-২ নম্বরের বড়বাগ বাজারের পেছনের বাসিন্দা রাবেয়া ইসলাম। পাঁচ দিন পরও সেই তেলের কিছুটা রয়ে গেছে বলে জানান তিনি। বড়বাগে ফুটপাতে একটি চায়ের দোকান চালান রাবেয়া। কথা প্রসঙ্গে রাবেয়া বলেন, ‘আজকে (শনিবার) ভেন্ডি ভাজি করছি। ভেন্ডি চুলায় দিয়া তেল ছাড়াই একটু নাড়াচাড়া করছি। সিদ্ধ হওয়ার পরে হালকা একটু তেল দিয়া কোনো রকমে ভাজি শেষ করছি।’
চলতি মে মাসে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি জাহাজে করে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল এসেছে। এই চার জাহাজে ৩ কোটি ৬৩ লাখ লিটার সয়াবিন ও পাম তেল রয়েছে। এসব তেলের প্রায় পুরোটাই খালাস করে বন্দরের পাশের ট্যাংক টার্মিনালে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে সয়াবিন ও পাম তেল নিয়ে কোম্পানিগুলো নিজস্ব কারখানায় পরিশোধনের পর পরিবেশকদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করে।
ঈদের পর গতকাল ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানাগুলো খুলেছে। ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষস্থানে থাকা টিকে, মেঘনা ও সিটি গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী, গতকাল তিন কোম্পানি মিলে ৪৬ লাখ লিটার সয়াবিন ও পাম তেল পরিবেশকদের সরবরাহ করেছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, খুচরা বাজারে দু–এক দিনের মধ্যে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।