গত ৫০ বছরে আয়, গড় আয়ু, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করল বাংলাদেশ। এই পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তো ভারত ও পাকিস্তান পেছনে পড়ে গেছে। বিশেষ করে আয় ও আয়ুতে দুই প্রতিবেশীর চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণও তুলনামূলক বেশি, যা নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে। অথচ স্বাধীনতার পরপর এসব খাতে ওই দুটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে ছিল।
বাংলাদেশ এমন এগিয়ে যাওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ একসময় ছিল কপালের লিখনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু স্বাধীনতার পর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। তারাই উন্নয়নের প্রধান কারিগর।’ এই অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সফলতা অর্জনের কারণগুলো হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি। তিনি বলেন, ‘আগামী ৫০ বছরে আমরা কতটা এগিয়ে যাব, সে জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আনা উচিত।’
এবার দেখা যাক কোন কোন খাতে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশ।
মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পরপর দুই বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, চলতি ২০২১ সালে বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ২ হাজার ১৩৮ ডলার। আর ভারতে মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। বাংলাদেশ ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো
মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। মূলত করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় দেশটিকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। তবে মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে মানুষ কত আয় করল, সেটাই বোঝায়। এখানে রেমিট্যান্স যুক্ত হয় না। এটি দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও বোঝায়।
সাবেক পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের কারণে মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়। তখন মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ব্যাপক তফাত ছিল। স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশক বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় খুব বেশি না বাড়লেও গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়। ইকোনমিক সার্ভে অব পাকিস্তানের হিসাবমতে, ওই বছর পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬৭১ ডলার। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ওই বছর মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৭৫১ ডলার। এরপর শুধু বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানের দুই হাজার ডলার পার হলো মাত্র।
ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে বেশি দিন বাঁচে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ দশমিক ৬ বছর। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭ বছর ও ৬৭ দশমিক ৩ বছর। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের সুফল মিলছে গড় আয়ুতে।
শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের নারীরা ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছেন। ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে বাংলাদেশ। এ দেশের শ্রমশক্তিতে ৩৬ শতাংশই নারী। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে ২০-২২ লাখ নারী শ্রমিক আছেন। অন্যদিকে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ভারতে সাড়ে ২০ ও পাকিস্তানে ২২ শতাংশ।
আবার শ্রমশক্তিতে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যায়ও ওই দুটি দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রমশক্তির প্রায় ২৬ শতাংশ দক্ষ। অন্যদিকে এই হার ভারতে ২১ ও পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতের কিছু সূচকে বাংলাদেশ ভালো করেছে। যেমন স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে শিশুদের সুরক্ষায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশের শিশুরা জন্ম নেওয়ার পর পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ শিশুই বেঁচে থাকে। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতে প্রতি ১০০টি শিশুর মধ্যে ৯৬টি শিশু বেঁচে থাকে। পাকিস্তান এই হার ৯৩ শতাংশ। আবার ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ব্যাপক হারে কমেছে। বাংলাদেশে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এখন প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে মারা যান ১৭৩ জন।
বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা যেখানে ৮, সেখানে তা ভারতে ৫ ও পাকিস্তানে ৬। তবে চিকিৎসকের সংখ্যায় বাংলাদেশ পিছিয়ে।
শিক্ষায় বাংলাদেশের নারীরা বেশ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের ২৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই মাধ্যমিক পাস। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানে এই হার ২৭ শতাংশ।
নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম জায়গা জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার প্রায় ২১ ভাগ নারী। ভারত ও পাকিস্তানে এই হার যথাক্রমে ১৩ শতাংশ ও ২০ শতাংশ।