গল্পটা তখনকার, যখন ঘরে ঘরে ৬০ ওয়াটের টিমটিমে বাল্ব জ্বলত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ যেত আর সেই গতিতেই কেটে যেত বাল্ব, বাল্বের ব্যবসাও ছিল রমরমা। নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ ইব্রাহীম তখন একজন পাইকারি ব্যবসায়ী ছিলেন। এর ২৫ বছর পর তাঁর গল্পটা হয়ে উঠল অন্য রকম।
৬০ ওয়াটের বাতিকে হটিয়ে বাজার এখন এলইডি বাতির। ৩০ শতাংশ এলইডি বাতি তৈরি করে একটি প্রতিষ্ঠান, নাম সুপারস্টার গ্রুপ, সে গ্রুপেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহীম। শুধু বাতি তৈরি নয়, ইব্রাহীম সত্যিকার অর্থেই বিস্তার করেছেন তাঁর সাম্রাজ্য। সুইচ, সকেট থেকে শুরু করে এমন সব পণ্যই সুপারস্টার গ্রুপ তৈরি করে, যা একটি বাতি জ্বালাতে লাগে।
১৯৯৪ সালে বাতির দুনিয়া শাসনের স্বপ্ন নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ ইব্রাহীম। তাই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী যখন প্রস্তাব দেন সুপারস্টার নামটি, সেটাকেই লুফে নেন। বাংলাদেশে শুধু তারা পণ্যটি সংযোজন করত। তখন ভাবলেন, পুরো কাজটাই করলে কেমন হয়। নারায়ণগঞ্জে এক আবাসিক ভবনের নিচতলায় শুরু হলো এক প্রোডাক্ট লাইনের বাল্বের কারখানা। দক্ষতা কম, জ্ঞানেও ঘাটতি, কারখানাতেই নষ্ট হয়ে যেত ২০ শতাংশ বাল্ব, পরিবহনে আরও কিছুটা। তারপরও সবকিছু অতিক্রম করে মোহাম্মদ ইব্রাহীম টিকে গেলেন বাল্বের দুনিয়ায়।
ইব্রাহীমরা পাঁচ ভাই, তিনি তৃতীয়। বড় ভাই মোহাম্মদ জয়নাল আর ইব্রাহীম লাগলেন বাল্বের পেছনে, চতুর্থ ভাই জালাল উদ্দীন বসলেন পুরোনো বাল্বের পাইকারি ব্যবসায়, মেজ ভাই মহিউদ্দীন গেলেন বিদেশে আর সবচেয়ে ছোট হারুন-অর-রশিদকে সুযোগ দেওয়া হলো পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসায় যোগ দেওয়ার।
পাইকারি ব্যবসা করায় ইব্রাহীমরা আগেই জানতেন ক্রেতারা কী চান। পরিচয় ছিল সাপ্লাই চেইনের সঙ্গেও, সেই সম্পর্কই দারুণ কাজে এল। শুধু কাজ করতে হলো উৎপাদন ব্যবস্থায়। এভাবে পাঁচ ভাই মিলে দাঁড়িয়ে ফেললেন সুপারস্টার। ধীরে ধীরে বদলে গেছে বাতির দুনিয়াও। ট্যাংস্টেনট বাল্ব বদলে এল টিউবলাইট, এরপর এনার্জি সেভিং বাল্ব। ইব্রাহীমরাও দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো তাঁদের ডিম রাখতে শুরু করলেন আলাদা আলাদা ঝুড়িতে, শুরু হলো সুপারস্টার সুইচের।
দেশে তখন সুইচ ব্যবসা পুরোটাই ভারতীয়দের দখলে। চীন থেকে ছোট ছোট যন্ত্রাংশ এনে জুড়ে শুরু করা হয় সুপারস্টার সুইচ। এভাবেই ভাইদের নিয়ে ইব্রাহীম এগিয়ে আসেন দেশের অন্যতম বাতি নির্মাতার কাতারে।
কথা হয় সুপারস্টার ভাইদের সবচেয়ে ছোটজন হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে। বললেন, ‘আমি কোম্পানিতে যোগ দিই ১৯৯৯ সালে, জুনিয়র অফিসার হিসেবে। অফিসের সব ধরনের কাজ করতে হতো নিজ হাতে। কাজ করে করে পদোন্নতি পেয়ে এখন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক।’ হারুন লেখাপড়া করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর প্রায় পাঁচ বছর পর আবার পড়াশোনা করেছেন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়। কারণ, সুপারস্টারের চোখটাও এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দিকেই।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমাদের প্রথম লক্ষ্য সুইচ নিয়ে ভারতের বাজারে ঢোকা। সেই মতো আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী সুইচ তৈরি করছি। এর বাইরে তার বা কেবলের রাজ্যটা জয় বাকি আছে। আমরা কেব্ল তৈরিতেও কাজ করছি। এ ছাড়া মালয়েশিয়াতে কিছু কাজ করার ইচ্ছা আছে।
কীভাবে এল সাফল্য? হারুন-অর-রশিদ বললেন, ‘প্রথমত আমাদের ভাইদের একতা, দ্বিতীয়ত, আমাদের করপোরেট গভর্নেন্স খুব শক্তিশালী, সঠিক কর্মী নিয়োগ, তাঁদের ক্ষমতায়ন, লক্ষ্যের সঙ্গে তাঁদের একাত্ম করা—এসবই সাফল্যের একটি কারণ। আমরা কর্মীদের বিশ্বাস করি, তাঁদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিই। সেই বিশ্বাসই সাফল্যের কারণ সুপারস্টারের।