অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে ব্যাংক খাত নিয়ে একটি কমিশন গঠিত হচ্ছে। আর এই কমিশনের চেয়ারম্যান হচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বুধবার সচিবালয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যাংক কমিশন করব। এ জন্য অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলতে হবে। যাঁরা সময় দিতে পারেন, দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারেন, তাঁদের মধ্য থেকেই কেউ এই কমিশনের দায়িত্ব নেবেন।’ তিনি স্পষ্ট করে কিছু না বললেও এ নিয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জানা গেছে।
আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে প্রথম বলেছিলেন, ব্যাংক খাতের কার্যক্রম মূল্যায়নে তিনি একটি কমিশন গঠন করতে চান। মুহিতের যুক্তি ছিল, ব্যাংক খাতের উল্লেখযোগ্য প্রসার হয়েছে। এখন প্রয়োজন এই খাতের সঞ্চয়ন, সুষ্ঠু নীতিমালা ও প্রবৃদ্ধির ধারা নির্ধারণ। মুহিতের ভাষায়, ‘ব্যাংক খাতের প্রচলিত কার্যক্রম এবং এ খাতের সার্বিক অবস্থান মূল্যায়ন ও বিবেচনা করার জন্য একটি কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা আমাদের রয়েছে।’
এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিটি বাজেট বক্তব্যেই মুহিত ব্যাংক কমিশন গঠনের পক্ষে কথা বলে গেছেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। নতুন অর্থমন্ত্রী হয়ে আ হ ম মুস্তফা কামালও ঘোষণা দেন, ব্যাংক খাত নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের চিন্তা রয়েছে তাঁর। মাঝখানে কমিশনের পরিবর্তে কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংস্কারের উদ্যোগও নিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, নতুন ব্যাংকের বেশি পরিচালন ব্যয়, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণ প্রদান, সরকারি ব্যাংকের পর্ষদের দুর্বলতা, মূলধন ঘাটতি ইত্যাদি কারণকে সামনে এনে বিশেষজ্ঞরা ব্যাংক খাত সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে আসছেন ১০ বছর ধরে। অবস্থা সংকটজনক থাকলেও রহস্যজনক কারণে সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করেনি। অর্থাৎ এ খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছে সরকার।
>দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে অবশেষে একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
১৯৯৬ সালে ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সাবেক সচিব কাজী ফজলুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ওই সময় গঠন করা হয়েছিল ছয় সদস্যের ব্যাংক সংস্কার কমিটি। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন ওই কমিটির অন্যতম সদস্য। পরে অবশ্য কাজী ফজলুর রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে করা হয় কমিটির চেয়ারম্যান। কমিটি ৩৭টি সভা করেছিল এবং ১১টি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করেছিল। যদিও ওই সুপারিশের বেশির ভাগই সরকার পরিপালন করেনি।
গত কয়েক বছরে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকে একের পর এক কেলেঙ্কারি হয়েছে। সোনালী, জনতা ও অগ্রণীকে ‘লিমিটেড কোম্পানি’ করেও কোনো লাভ হয়নি। নতুন কমিশনে এ বিষয়গুলোর পর্যালোচনা থাকা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি কারণে স্বাগত জানাই। প্রথমত, ব্যাংক কমিশন হচ্ছে জেনে; দ্বিতীয়ত, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে চেয়ারম্যান করা হচ্ছে বলে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, নতুন কমিশন ভালো কাজই করবে বলে আস্থা রাখা যায়। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে চলা, সুশাসন আনা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় রাখা, খেলাপি ঋণ কমানোর পথ বের করা ইত্যাদি বিষয় কমিশনের কার্যপরিধিতে থাকতে হবে।