>আনিস এ খান, এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হলেও বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সুপরিচিত নাম। বিভিন্ন সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি), প্রাইমারি ডিলার বাংলাদেশ লিমিটেড (পিডিবিএল) ও সুইফট বাংলাদেশ ইউজার গ্রুপের। এর পাশাপাশি বার্জার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানি, বিডি ভেঞ্চার, আইআইডিএফিসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত তিনি। এমডি হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শেষ হচ্ছে ৩০ নভেম্বর। এরপর এমটিবির এমডি পদে যোগ দেবেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা অধিগ্রহণ করতেই হবে। সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রেই এ উদ্যোগ প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প নেই। এতে ব্যাংকগুলোর ভিত্তি শক্তিশালী হবে।
দায়িত্বের শেষ সময়ে গতকাল সোমবার এমটিবির প্রধান কার্যালয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে ব্যাংক খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন আনিস এ খান।
স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে
প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আনিস এ খান বলেন, ব্যাংকগুলোকে করপোরেট গভর্নেন্স মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
১৬ কোটি মানুষের দেশে ৬০ ব্যাংক অনেক
আনিস এ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের যে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার সঙ্গে ব্যাংক খাত সরাসরি জড়িত। অবকাঠামো, সেবা খাত সবকিছুর সঙ্গেই ব্যাংকগুলো জড়িত। পাশাপাশি বড় আকারের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তবে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৬০টি ব্যাংক অনেক বেশি। এ কারণে ব্যাংকগুলোর করপোরেট গভর্নেন্সে কিছু সমস্যা হচ্ছে।’
ব্যবসা ধরতে গিয়ে ব্যাংকগুলো আপস করছে
ব্যাংকারদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে আনিস এ খান, ‘ব্যাংকের ব্যবসা ৮০ শতাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। এর বাইরে বড় কোনো ব্যবসা নেই। এ ব্যবসা ধরতে গিয়ে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এর ফলে অনেক সময় ব্যাংকগুলো আপস (কম্প্রোমাইজ) করছে। কারণ, মুনাফার একটা লক্ষ্য থাকে, ব্যাংকের পর্ষদের দিকেও দেখতে হয়। এটা কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না। যেকোনো অবস্থাতেই ব্যাংকগুলোকে করপোরেট গভর্নেন্স মানতে হবে।’
আনিস এ খান বলেন, ‘ব্যাংকের কাজ গ্রাহকদের থেকে আমানত নিয়ে আবার বিনিয়োগ করা। আবার ঋণগ্রহীতাদেরও চিন্তা করতে হবে। যে কাজে ব্যাংক টাকা দিয়েছে, সে কাজেই ব্যবহার করতে হবে। জমি বা অন্য খাতে টাকা খাটানো যাবে না। ব্যাংকারদের সব সময় চিন্তা করতে হবে, কাকে টাকা দিচ্ছি। ব্যবসায়ী সৎ কি না। টাকার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কি না না। এসবে নজরদারি বাড়াতে হবে।’
অন্য দেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি তুলে ধরে আনিস এ খান বলেন, ১৯৯০ সালের দিকে একটা মন্দা হয়েছিল। কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মুদ্রার অনেক অবমূল্যায়ন হয়েছিল। এসব দেশে ব্যাংকগুলো একীভূত ও অধিগ্রহণ হয়েছে। এসব ব্যাংক এখন কত শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ফলে দেশগুলোর অর্থনীতিও মজবুত হয়ে গেছে। সম্প্রতি ভারতও কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করে ফেলল। তাই বাংলাদেশকে একই পথে যেতে হবে।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আনিস এ খান বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক একীভূত হওয়ার সময় টিম লিডার হিসেবে কাজ করার। পরে তারা আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকও কিনল। আজকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড কোন অবস্থানে পৌঁছেছে। এখন বিদেশি কোনো ব্যাংক বাংলাদেশে আসতে ভয় পায়। এইচএসবিসি ও সিটিএনএ থাকলেও কোনো রিটেইল ব্যবসা করছে না। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড একাই সব ব্যবসা করছে।’
এ নিয়ে আনিস এ খান বলেন, ‘ব্যাংক এশিয়া আমাদের সমসাময়িক ব্যাংক। তারাও অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। তারা কানাডীয় নোভা-স্কশিয়া ব্যাংকের কার্যক্রম অধিগ্রহণ করল, ফ্রান্সের সোসাইটি জেনারেলও নিল। আবার মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের কার্যক্রমও অধিগ্রহণ করল। ব্যাংক এশিয়া এখন অনেক শক্তিশালী একটি ব্যাংক। ’
ব্যাংক খাতে সুশাসনের উদ্যোগ নিতে হবে
ব্যাংক খাতের সুশাসন নিয়ে আনিস এ খান বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সুশাসনের উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকেও আসতে হবে। সরকারে অনেক অভিজ্ঞ ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আছে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত। তাঁদের কাছে অনুরোধ করব, যাতে ব্যাংক খাতে বেস্ট করপোরেট গভর্নেন্স প্রয়োগের ব্যবস্থা করেন। তাঁরাই আমাদের নেতা। তাঁরা নীতি প্রণয়ন করেন। তাঁরা চাইলেই অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঠিক হয়ে যাবে। দেশের ব্যাংক খাতও ঠিক হয়ে যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আনিস এ খান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। জাপান ও যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেমন দেওয়া হয়েছে, তার ৯০ শতাংশ হলেও দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবার পরামর্শ শুনবে, তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বাধীনভাবে। এখনকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ২ জন ডেপুটি গভর্নর দিয়ে চলে না। দীর্ঘদিন দুটি পদ খালি। এ নিয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
ব্যাংকে দক্ষ কর্মীসংকট নিয়ে আনিস এ খান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় ঘাটতি হয়ে গেছে। আমাদের প্রজন্ম ভালো শিক্ষা পেয়েছে। তবে সামরিক সরকারের সময় শিক্ষাব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। ইংরেজি শিক্ষা তুলে দিয়ে ওই প্রজন্মের জন্য পৃথিবীটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর রেশ অনেক দিন চলেছে। আমরা তো জাপান বা কোরিয়া না, যে নিজের ভাষায় সব হবে। এর ফলে ওই সময়ে যারা শিক্ষা নিয়েছে, তারা পিছিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ইংরেজিতে। তবে এখনকার প্রজন্ম অনেক ভালো করছে।’
শেয়ারবাজারে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন
দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে আনিস এ খান বলেন, ‘আমাদের শেয়ারবাজারে মাত্র ৩১০টি কোম্পানি। এটা দুঃখজনক। এ দিয়ে দেশের শেয়ারবাজার চলে না। শেয়ারবাজারে মানুষের আস্থা একেবারে নিচের দিকে। এ জন্য বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সেটা নিয়ন্ত্রক ও স্টক দুই ক্ষেত্রেই। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। আবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে দীর্ঘদিন প্রধান নির্বাহী নেই।’
আনিস এ খান ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে যোগদান করেন। এরপর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বাংলাদেশে শীর্ষ পর্যায়ে ও দুবাইতেও কাজ করেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির এমডি ছিলেন ২০০৯ সাল পর্যন্ত। আজকের আইডিএলসি ওই সময়েই মূলত ভালো অবস্থানে যায়। এরপর যোগ দেন এমটিবিতে।
আনিস এ খান, ‘মনে হয় সেদিন গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ৩৭ বছর চলে গেল। খুব ভালোভাবে কেটেছে আমার ব্যাংক জীবন। সবাই আমাকে অনেক সম্মান দেখিয়েছে।’