কর ফাঁকিতে এইচএসবিসির সহায়তা

ব্যাংক ইতিহাসের বড় কেলেঙ্কারি

.

কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ অর্থ পাচারে গ্রাহকদের সহায়তা করায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে এখন পর্যন্ত এ ঘটনাকে বিশ্ব ব্যাংকিং ইতিহাসে তথ্য ফাঁসের অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

বিশ্বের ২০৩টি দেশের ১ লাখ ৬ হাজার ব্যাংক হিসাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশভিত্তিক একটি তালিকা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক কনসোর্টিয়াম (আইসিআইজে)। বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ হিসাব করে এ তালিকা করা হয়েছে। ফরাসি পত্রিকা লা মঁদ, ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম আইসিআইজের সঙ্গে এ অনুসন্ধান চালায়।

 আইসিআইজের তথ্যমতে, এইচএসবিসির সুইস ব্যাংকিং শাখাটি নিয়মিতভাবেই গ্রাহকদের বিদেিশ মুদ্রায় বিপুল নগদ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছে, যা সুইজারল্যান্ডে আইনত অনুমোদিত নয়। এ ছাড়া সম্পদশালী গ্রাহকদের কর ফাঁকিতে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আগ্রাসী মার্কেটিং কার্যক্রমও পরিচালনা করেছে ব্যাংকটি। আন্তর্জাতিক অপরাধী, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও উচ্চমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট খুলতে সহযোগিতার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে।

২০০৮ সালের শেষের দিকে এইচএসবিসির সুইস শাখার সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী হার্ভে ফালসিয়ানি এক লাখের বেশি গ্রাহকের তথ্য চুরি করে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। ফ্রান্স পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তাঁর কাছে থাকা ফরাসি নাগরিকদের কর ফাঁকির মূল্যবান তথ্য পেয়ে দেশটি তাঁকে সুইজারল্যান্ডের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। পরে দেশটির তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দে সম্ভাব্য দুই হাজার কর ফাঁকিদাতার একটি তালিকা তৈরি করেন, যা ‘লাগার্দে তালিকা’ নামে পরিচিত।

২০১০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশের কর কর্তৃপক্ষ এ তথ্যগুলোর প্রতি প্রবেশাধিকার পেলেও জনসম্মুখে সেগুলো পুরোপুরি গোপনই রাখা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসে সুইস ব্যাংকটির এ অবৈধ কার্যকলাপ প্রকাশ হয়ে পড়ে।

ফরাসি কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ তথ্যগুলো সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে দেশটির স্থানীয় পত্রিকা লা মঁদ। পরে লা মঁদ আইসিআইজের কাছে এ তথ্যগুলো সম্পর্কে জানায় এবং এ নিয়ে আরও তদন্ত করতে আইসিআইজে ৪৫টি দেশে নানা সাংবাদিকসহ অন্যান্য গণমাধ্যম নিয়োগ করে। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল সময় পর্যন্ত এইচএসবিসির যাবতীয় অবৈধ কার্যকলাপের ওই তথ্যগুলোকে বলা হচ্ছে ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তথ্য ফাঁস।

কর ফাঁকি দেওয়া ও সম্পদ লুকাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এইচএসবিসির সহায়তা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক অপরাধী, করপোরেট নির্বাহী থেকে শুরু করে হলিউড তারকা, খেলোয়াড়, গায়ক ও বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের সদস্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও আছেন।

যে এক লাখের বেশি ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলোতে মোট জমা করা অর্থের পরিমাণ ১১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি। হার্ভি ফ্যালসিয়ানির ফাঁস করা তথ্যের ভিত্তিতে ফ্রান্সে কর কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত সেই তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শতকরা ৯৯ দশমিক ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

এ তালিকায় বাংলাদেশের অন্তত ১৬ নাগরিকের অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। ৩১টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করা অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এক হিসাবের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারের পরিমাণ ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার। এ তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮ নম্বরে।

আইসিআইজের তালিকায় উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারত ১৬তম অবস্থানে আছে। ভারত থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৪১০ কোটি ডলার। এ তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান ৪৮, পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।

তালিকার ১১২ ও ১১৬তম অবস্থানে আছে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। শ্রীলঙ্কা থেকে ৬ কোটি, নেপাল থেকে ৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। আর আফগানিস্তান থেকে ৩০ লাখ ডলার।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৩ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেিশদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১২ সালে তা ছিল ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক দশকের মধ্যে ২০১৩ সালেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি অর্থ গচ্ছিত ছিল।

আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স (জিএফআই) ‘ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৩-১২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার অবৈধভাবে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০০৬ সালে, ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে চলে যায় ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১২ সালে অর্থ পাচার হয়েছিল ১৭৮ কোটি ডলার। আর ২০১১ সালে অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে চলে যায় ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

এক বিবৃতিতে সুইজারল্যান্ড এইচএসবিসি ব্যাংক শাখা জানায়, সংস্কারের পর এইচএসবিসির সুইজারল্যান্ড শাখা তাদের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়েছে। বর্তমান সময়ের তুলনায় ওই সময়ে সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকটির প্রাইভেট ব্যাংকিং শাখাটির আইন প্রতিপালন সংস্কৃতি ও মানদণ্ড যথেষ্ট নিম্নমানের ছিল।

যুক্তরাজ্যের সাবেক কর পরিদর্শক রিচার্ড ব্রুকস বিবিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এইচএসবিসি কর ফাঁকি ও প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠান। জেনে শুনে মানুষকে কর ফাঁকিতে সহযোগিতা করে। এর দায় তারা এড়াতে পারে না।’

ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছেন, তালিকায় থাকা ভারতীয় ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব তদন্ত করা হবে। এর আগে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে ভারতে ৬২৮ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের তদন্ত এখনো চলছে।

৬২৮ ব্যক্তির মধ্যে ২০০ জনের হদিস ভারত সরকার বের করতে পারেনি। বাকি ৪২৮ ভারতীয় নাগরিককের পরিচয় শনাক্ত করেছে দেশটির সরকার। এই ৪২৮ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি রুপি পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এইচএসবিসির মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি কর ফাঁকি দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, গ্রিস, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ভারত ও বেলজিয়ামে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে হাউস অব কমন্সের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি এইচএসবিসি ব্যাংকের এ কেলেঙ্কারি তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এইচএসবিসির সাবেক প্রধান ও যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী স্টিফেন গ্রিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনা আছে এ কমিটির।

যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটের ব্যাংকিং বিষয়ক কমিটি দেশটির সরকারকে তদন্ত করার জন্য এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করেছে। এর আগে ২০১২ সালে মেক্সিকোর মাদক ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯০ কোটি ডলার জরিমানা করে ব্যাংকটিকে।

বেলজিয়ামের একটি আদালত এইচএসবিসি ব্যাংকের সুইজারল্যান্ড শাখার পরিচালকদের গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পদক্ষেপ নিয়েছে। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভালস এমন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সুইজারল্যান্ডের রাজনীতিবিদেরাও ঘটনা তদন্তে দেশটির সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এইচএসবিসি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলোকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।

মোট গ্রাহক ১০৬,০০০

মোট দেশ ২০৩

মোট গচ্ছিত অর্থ ১১,৮০০ কোটি ডলার

সুইজারল্যান্ডের গ্রাহক ১১,২৩৫ (৩,১২০ ডলার)  ফ্রান্সের গ্রাহক ৯,১৮৭ (১,২৫০ কোটি ডলার)  যুক্তরাজ্যের গ্রাহক ৭,০০০ (২,১৭০ কোটি ডলার)

শীর্ষ ৫ দেশ

সুইজারল্যান্ড

৩১.২ বিলিয়ন

যুক্তরাজ্য

২১.৭ বিলিয়ন

ভেনেজুয়েলা

১৪.৮ বিলিয়ন

যুক্তরাষ্ট্র

১৩.৪ বিলিয়ন

ফ্রান্স

১২.৫ বিলিয়ন

শীর্ষ ৫ ব্যক্তি

দিয়েগো ফোরলান

উরুগুয়ের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল বিজয়ী

ক্রিস্টিয়ান স্ল্যাটার

মার্কিন অভিনেতা। ১৯৮০ ও ১৯৯০–এর দশকে বিদ্রোহী ও মন্দ ছেলের চরিত্র অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান

ফিল কলিনস

যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞ। গ্র্যামি, একাডেমি ও গোল্ডেন গ্লোবস পুরস্কার বিজয়ী 

কার্টেস জারা

ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মাত্র চার বছর পর ২০১৩ সালে প্যারাগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন

বাদশাহ মোহাম্মেদ

মরক্কোর বাদশাহ এবং ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার। ২০১৪ সালে আফ্রিকার ষষ্ঠ সেরা ধনী

বাংলাদেশের ১৬ গ্রাহকের ৩১ হিসাবে ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার

কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যবসায়ী–শিল্পপতি, রাষ্ট্রপতি, রাজা–বাদশাহ, খেলোয়াড়, শিল্পী, বিচারক ও আইনজীবী রয়েছেন