জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ও পরিবেশদূষণ কমাতে সারা বিশ্বেই বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ দেশ ভারতে ইতিমধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) উৎপাদন শুরু হয়েছে। টাটাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি ইতিমধ্যে ইভি তৈরি করছে।
ভারতের পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়করি নিজেও বিকল্প জ্বালানির বিষয়ে অত্যন্ত উৎসুক। গত মার্চ মাসে তিনি হাইড্রোজেন জ্বালানিনির্ভর গাড়ি চালিয়ে সংসদে যান। তাঁর এই উদ্যোগ থেকে এটা স্পষ্ট, ভারত বৈদ্যুতিক বা বিকল্প জ্বালানিনির্ভর গাড়িতে কতটা জোর দিচ্ছে। বস্তুত দেশটি চায়, ২০৩০ সালের মধ্যে সে দেশে নতুন বিক্রীত গাড়ির ৩০ শতাংশই যেন ইভি হয়।
বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির অন্যতম বৃহৎ বাজার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ভারতের, এমনই দাবি করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও ওলা মোবিলিটি ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রতিবেদনে। তবে একই সঙ্গে তারা বলেছে, এমন গাড়ি কেনা ও তা চালানোর খরচ বেশি হওয়ায় ভারতে সেগুলোর চাহিদার গতি এখনো শ্লথ। তাই গবেষণা খাতে দীর্ঘমেয়াদি লগ্নির পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা ও দিশা অত্যন্ত জরুরি বলেও জানিয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
উল্লেখ্য, দূষণ ও তেল আমদানির খরচ কমানোর জোড়া লক্ষ্য পূরণে বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর কয়েক বছর ধরেই জোর দিচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। গাড়িশিল্পের অভিযোগ ছিল, তাড়াহুড়ো করে কোনো স্পষ্ট দিশা ছাড়াই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা দেশের রাস্তায় শুধুই বৈদ্যুতিক গাড়ি চালানোর দিনক্ষণ যেভাবে বেঁধে দিচ্ছেন, তা বাস্তবসম্মত নয়। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবাইকে এ নিয়ে আশ্বস্ত করেন।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিহার, দিল্লি, কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ুর মতো ১০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করছে।
এই বাস্তবতায় নিতিন গড়করির বক্তব্য, ‘পরিবেশবান্ধব জ্বালানির প্রতি আমার পক্ষপাত আছে। এই খাতে যত গবেষণা হবে, ততই বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম কমতে থাকবে, একসময় পেট্রলচালিত গাড়ির দামে নেমে আসবে এসব বৈদ্যুতিক গাড়ি।’
ভারতের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগের তথ্যানুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের টু ও থ্রি হুইলারের ৮০, বাসের ৪০ ও ৩০-৭০ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি বিদ্যুচ্চালিত হবে।
পৃথিবীর অন্যতম দূষিত শহর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। শুষ্ক মৌসুমে এই শহরে নিশ্বাস নেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু দিল্লি নয়, উন্নয়নশীল দেশ ভারতের অনেক শহর এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষিত শহরের তালিকায়। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশদূষণ রোধে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার গতি নেই ভারতের। কপ–২৬ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের অঙ্গীকার, ২০৭০ সালের মধ্যে তারা কার্বন নিঃসরণের হার প্রাক্শিল্প যুগের সাপেক্ষে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবে। আর ২০০৫ সালের সাপেক্ষে ২০৩০ সালের মধ্যে দূষণের মাত্রা ৪৫ শতাংশ হ্রাস করবে।
তবে শুধু বৈদ্যুতিক গাড়ি নয়, এই ভয়াবহ দূষণ থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতের যোগাযোগব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন ভারতের ভারী শিল্পমন্ত্রী নাথ পাণ্ডে। রাস্তায় হাঁটার পরিবেশ উন্নয়ন, গণপরিবহন, রেলওয়ে, উন্নত গাড়ি বা ইভি—এই সবকিছুর সমন্বয় ঘটাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
ভারতে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, তার ১৮ শতাংশই হয় পরিবহন খাতে। বছরে তার দরকার পড়ছে ৯৪ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৪০ লাখ টন জ্বালানি। আর চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তাতে ২০৩০ সালে এই চাহিদার পরিমাণ দাঁড়াবে ২০০ মেট্রিক টন।
হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক গাড়িতে। আর তার ইঞ্জিনও প্রচলিত তেলভিত্তিক গাড়ির ইঞ্জিনের চেয়ে উন্নত। বৈদ্যুতিক গাড়ি ধোঁয়া নির্গত করে না, বরং বাষ্প ও পানি নির্গত করে। ভারতের শিল্পবিশ্লেষকদের মত, বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রকল্প সফল হলে বছরে ভারতের ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। টু ও থ্রি হুইলারের দ্রুত প্রচলন হলে এটা সম্ভব।
বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রধান বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ায় এই গাড়ির ডিজাইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে জন্য গাড়ির ডিজাইন নিয়ে আরও গবেষণার পরামর্শ দিয়েছেন নিতিন গড়করি। এ ছাড়া কিছুদিন আগে ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের পরিকল্পনা বাতিল করেছে আমেরিকার গাড়ি কোম্পানি ফোর্ড মোটরস। সুনির্দিষ্ট কারণ না দেখালেও গত বছর তারা বলেছিল, অলাভজনক হওয়ায় গাড়ি উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
অর্থাৎ সমস্যা আছে। ডয়চে ভেলের এক সংবাদে বলা হয়েছে, গাড়ির উচ্চ মূল্য, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইভির অভাব এই শিল্পের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবকাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চার্জিং স্টেশন। বলা হচ্ছে, বাজারে ১০ কোটি ইভি থাকলে গণচার্জার প্রয়োজন হবে ২৯ লাখ, যা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়।
ভারতে এখনো মোট বিক্রীত গাড়ির মাত্র ১ শতাংশ হচ্ছে ইভি। ফলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, প্রতিটি রাজ্যের ইভির লক্ষ্যমাত্রা থাকা দরকার, অর্থাৎ কত সালের মধ্যে তারা কত ইভি নামাতে চায়। যেমন রাজধানী নয়াদিল্লির লক্ষ্যমাত্রা হলো, ২০২৪ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার নিশ্চিত করা। ইতিমধ্যে তাদের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ গাড়ি বৈদ্যুতিক।
তবে ভারত সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে করপোরেট খাতও এগিয়ে আসছে। মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স বলেছে, তারা হাইড্রোজেন জ্বালানির দাম ২০৩০ সালের মধ্যে কেজিপ্রতি ১ ডলারে নামিয়ে আনবে (এখন ৫ ডলার)। টাটা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করছে। সেই সঙ্গে সেমিকন্ডাক্টর বানাচ্ছে তারা। সামগ্রিকভাবে স্থানীয় সরবরাহব্যবস্থা তৈরি করছে তারা।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রিলায়েন্স ও আম্বানি বড় ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছে ঠিক। তবে তারা যত বড় হয়েছে, সেই বাস্তবতায় এ ধরনের ঝুঁকি নেওয়া তাদের সাজে। ভারতের ভবিষ্যৎ রূপান্তরে এদের বড় ভূমিকা থাকবে।