প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থ বিভাগের কৌশলপত্র দেখে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন এবং শিগগির আইন প্রণয়ন করতে বলেছেন।
ছয় বছর ধরে আলোচনা চলছে, আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে অর্থমন্ত্রীরা প্রতিবারই বাজেটে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু হয় হয় করেও কাজের কাজ হচ্ছিল না। অবশেষে ‘সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা’ চালু হওয়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট আভাস মিলেছে। পেনশন তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হবে, এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা প্রদানের পাশাপাশি শিগগির আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুরুর দিকে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থাটি চালু হবে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে। অবশ্য তার আগেই প্রণয়ন করা হবে আইন। তবে সরকার আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে এ পেনশনব্যবস্থা চালুর কথা ভাবছে।
এ সম্পর্কে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতের ষাটোর্ধ্ব জনগণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন।
সিদ্ধান্ত যেহেতু হয়ে গেছে, সেহেতু এখন আর সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার বাস্তব রূপ দেখতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আশা করি, ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে এ ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে।এম এ মান্নান, পরিকল্পনামন্ত্রী
অর্থ মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার কৌশলপত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন। এটি চালু করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একমত হয়েছেন। তবে তিনি এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি নতুন কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী দেশের আপামর জনগণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। সে আলোকে কৌশলপত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি প্রণয়নে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ ব্যাপারে পরে বিস্তৃত আকারে গণমাধ্যমের কাছে জানাতে পারে। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হলে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীরাও পেনশনের আওতায় আসবেন।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত থাকা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান রাতে মুঠোফোনে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এটি জাতির জন্য উপহার হিসেবে আসবে। সিদ্ধান্ত যেহেতু হয়ে গেছে, সেহেতু এখন আর সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার বাস্তব রূপ দেখতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আশা করি, ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে এ ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। শুরুর দিকে ঐচ্ছিক হলেও পরে তা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।’
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তারা আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ ব্যাপারে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছিল। তখন এটি আর বেশি দূর এগোয়নি। পরে অর্থ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ আর এম নাজমুস সাকিবের নেতৃত্বে গঠিত একটি দল একটি কৌশলপত্র তৈরি করে। এ কৌশলপত্রের মূল বিষয়গুলোই প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন অর্থসচিব।
সূত্রগুলো জানায়, বেসরকারি খাতের চাকরিতে নিয়োজিত ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী নাগরিকদের কথা মাথায় রেখেই আপাতত সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করা হবে। এমন চিন্তা করা হচ্ছে যে একটি প্রতিষ্ঠান কর্মীদের জন্য একটি অংশ ব্যয় করবে, কর্মীরা নিজেরা দেবেন একটি অংশ। এই টাকা সরকার কোথাও খাটিয়ে যে আয় হবে, তা থেকে একটা অংশ দুই পক্ষের জমা করা অর্থের সঙ্গে যোগ করে পেনশন দেওয়া হবে। এটি বাস্তবায়নের শুরুর দিকে কারিগরি সহায়তা নেওয়া হবে বিশ্বব্যাংক থেকে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বাজেট বক্তব্যে বলেছিলেন, দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাঁদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার, তা বেশির ভাগ প্রবীণেরই থাকে না। ফলে শেষ বয়সে তীব্র অর্থকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেন তাঁরা।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ছয় কোটির বেশি কর্মজীবীর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কাজ করেন বেসরকারি খাতে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ দেশের সব জনগণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে চালু করতে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেওয়া হবে এবং ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা রাখা হতে পারে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সাড়ে ১১ লাখ সরকারি চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন। এতে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়।
সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন করপোরেশনের কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করে গণকর্মচারী (অবসর) আইন প্রণয়ন করা হয় ১৯৭৪ সালে। এর মাধ্যমে গণকর্মচারীদের চাকরিজীবনের সর্বশেষ উত্তোলনকৃত বেতনের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ (সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ) পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হলে এখানেও পরিবর্তন আনা হবে বলে জানা গেছে।